ইটালি ও স্পেনের মতো করোনা সংকটে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ৷ জার্মানির মতো দেশ ইউরোপীয় সংহতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে, এমন ধারণাই জোরালো হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
সংকটের সময় যুক্তি না আবেগ, কোনটা কাজ করে? এই প্রশ্নের উত্তর বেশিরভাগ মানুষের কাছেই স্পষ্ট৷ করোনা সংকটের সময় ইউরোপের মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়৷ ইটালির হাসপাতালে যখন ভেন্টিলেটরের অভাবে একাধিক মুমূর্ষু রোগীদের মধ্যে বাধ্য হয়ে একজনকে আরও চিকিৎসার জন্য বেছে নিতে হচ্ছে, তখন অসহায় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ যে ফেটে পড়ার কারণ তো থাকবেই৷ বিশ্বের সেরা শিল্পোন্নত দেশগুলির অন্যতম হওয়া সত্ত্বেওচীন ও কিউবার মতো দেশের ডাক্তারদের সহায়তা নিতে হচ্ছে, এমনটা দেখে সেই ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে৷ মাদ্রিদে মৃত্যুলীলার ফলে এমনকি প্রিয়জনকে দাফনের কাজও মাত্র পনেরো মিনিটে সারতে হলেও এমন অসহায়বোধ ও ক্ষোভ অস্বাভাবিক নয়৷ করোনা সংকট এমন সব অবিশ্বাস্য দৃশ্য বাস্তব করে তুলছে৷ বিশেষ করে ইউরোপের দক্ষিণে অনেক মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে, কোথায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কোথায় ইউরোপের সংহতিবোধ? সংকটের সময়ে ইইউ পাশে না দাঁড়ালে এমন রাষ্ট্রজোটের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি?
ইউরোপের বসন্ত উৎসবে করোনার হানা
দীর্ঘ শীতের পর বসন্ত নিয়ে আসে গ্রীষ্মের বার্তা৷ তাই এপ্রিল থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ মাতে উৎসব আয়োজনে৷ কিন্তু করোনা সংক্রমণের থাবা এবার গ্রাস করেছে প্রায় সব উৎসব৷ এবারের বসন্ত গেলো বৃথা৷
ছবি: DW/V.Kropman
কয়কেনহফের টিউলিপ উৎসব
ইউরোপের বাগান নামে পরিচিত নেদারল্যান্ডসের কয়কেনহফ৷ শহরটির টিউলিপ পার্কে প্রতি বছর নানা প্রজাতির অন্তত ৭০ লাখ টিউলিপ চাষ করা হয়৷ লাখ লাখ পর্যটক কেবল এই বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন এই ছোট্ট শহরে৷ দিনের শেষে রঙিন আয়োজনে প্যারেডও এর অন্যতম আকর্ষণ৷ তবে এবার টিউলিপ ফুটবে ঠিকই, দেখার জন্য আসবে না কেউ৷
ছবি: DW/A. Agrawal
আরএইচএস চেলসি ফ্লাওয়ার শো
এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে জুন মাস পর্যন্ত লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে চলে এই ফুলের মেলা৷ বাগান সাজানোর উদ্ভাবনী শিল্প, নানা রঙের ফুলের বাহার এবং অদ্ভুত সব বিরল উদ্ভিদ শোভা পায় এইসব প্রদর্শনীতে৷ তবে এ বছর করোনার প্রাদুর্ভাবে বাতিল করা হয়েছে প্রায় সব আয়োজন৷
ছবি: picture alliance/empics/M. Crossick
কিংস ডে
২৭ এপ্রিল নেদারল্যান্ডসের রাজার জন্মদিন৷ আর এই দিনটিকে কমলা পোশাকে সেজে নেচে-গেয়ে উদযাপন করে ডাচরা৷ কিন্তু এ বছর এই উদযাপন হচ্ছে না৷ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের বড় সমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ ফলে এবার নেদারল্যান্ডসের রাস্তাঘাটে কোনো দোকানপাট বা সঙ্গীত আয়োজন হবে না, খালগুলোতেও ভাসবে না রঙিন নৌকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/F. van Beek
প্রাগ বসন্ত উৎসব
ক্লাসিক্যাল মিউজিক ও অপেরা ভক্তদের জন্য অন্যতম এক আকর্ষণ প্রাগ স্প্রিং ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল৷ বিশ্বের সব নামীদামি মিউজিশিয়ান ও অর্কেস্ট্রা এই আয়োজনে প্রতি বছর যোগ দেয়৷ এ বছর ৭ মে থেকে শুরু করে ৪ জুন পর্যন্ত চলার কথা ছিল আয়োজনটি৷ কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চেক প্রজাতন্ত্রে চলছে জরুরি অবস্থা৷ বাতিল করা হয়েছে সব বড় আয়োজন৷ ফলে এই উৎসবও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: picture alliance/dpa/CTK Photo/M. Dolezal
ইস্টার আয়োজন
খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য ইস্টার অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব৷ কিন্তু ১২ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে এবার বেশিরভাগ দেশই করতে পারছে না বড় কোনো আয়োজন৷ করোনা ভাইরাসের কারণে ইউরোপ-অ্যামেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশই রয়েছে লকডাউনে৷ ফলে একেবারেই ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই সীমিত থাকছে এবারের আয়োজন৷ এমনকি এবারই প্রথম ভ্যাটিকান সিটিতে জনসমাগম ছাড়াই প্রার্থনা করবেন পোপ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Medichini
ভাইকিং উৎসব
প্রতি বছর মে মাস থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে শুরু হয় মধ্যযুগের উৎসব, ভাইকিং ফেস্টিভ্যাল৷ নিজেদের ঐতিহ্য আর পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান জানিয়ে অনেকেই সাজেন ভাইকিং যোদ্ধাদের সাজে৷ তবে অন্য সব ইউরোপীয় দেশের মতো নরওয়েতেও সংক্রমণ ঘটেছে করোনা ভাইরাসের৷ স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে, সব ধরনের আয়োজন নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ ফলে এ উৎসবের আয়োজনও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/empics/A. Milligan
6 ছবি1 | 6
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে ইউরোপের জনমানসে ক্ষোভ, বিরক্তি, তাচ্ছিল্যবোধ এবং উদাসীনতা আগেও দেখা গেছে৷ করোনা সংকট সেই মনোভাব আরও তীব্র করে তুলছে৷ বিশেষ করে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি উত্তরের অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ দেশের প্রতি অনেকেই ক্রোধ উগরে দিচ্ছে৷ ইটালি ও স্পেনের মতো দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির সময়ে নিঃশর্তে পাশে দাঁড়ানোর বদলে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতারা জটিল নিয়মকানুনের বেড়াজাল দেখিয়ে অমানবিক আচরণ দেখাচ্ছেন – এমন একটা ধারণা প্রাধান্য পাচ্ছে৷ এটা মানতেই হবে, যে করোনা সংকটের সময় ইইউ-র ভাবমূর্তি সত্যি মারাত্মক ধাক্কা খাচ্ছে৷ নেতৃত্ব দেখানোর বদলে ব্রাসেলস প্রক্রিয়াগত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যেই ডুবে রয়েছে৷
শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ও সরকার প্রধানরা মিলে অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তার উদার প্যাকেজ সম্পর্কে ঐকমত্যে এলেও ইইউ-র ভাবমূর্তির এই ক্ষতি সামলানো সহজ হবে না৷ এমনকি জার্মানিসহ ‘ধনী' দেশগুলি কোনো ইউরোপীয় তহবিলে উদারহস্তে বিশাল অঙ্কের অর্থ দান করলেও না৷ সেই পরিণতি ইউরোপীয় ঐক্য ও সমন্বয় প্রক্রিয়া থেকে সাধারণ মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলবে, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ সে ক্ষেত্রে ব্রেক্সিটের পর আমূল সংস্কারের মাধ্যমে ইইউ-কে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার স্বপ্ন এক ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে যেতে পারে৷ এমনটা হলে আখেরে ইউরোপের সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি হবে৷ অথচ তাঁদের ক্ষোভই সেই অবস্থার জন্য অন্তত আংশিকভাবে দায়ী হবে৷