বিশ্বজুড়ে করোনা সংকট মোকাবিলায় টিকা ও ওষুধ নিয়ে জোরালো গবেষণা চলছে৷ কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও কভিড-১৯ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব এমন উদ্যোগের সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলছে৷
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা করতে মোটামুটি তিন ধরনের প্রচেষ্টা চলছে৷ প্রথমত টিকা আবিষ্কার করে বিশ্বের মানুষকে করোনার থাবা থেকে আগেভাগেই বাঁচানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেক দেশের গবেষক৷ কিন্তু সেই প্রচেষ্টা যে বেশ সময়সাপেক্ষ, চরম আশাবাদীরাও সেই বাস্তব মানতে বাধ্য হচ্ছেন৷ দ্বিতীয় প্রচেষ্টার আওতায় করোনা ভাইরাস নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে৷ সেই উদ্যোগ সফল হলে অন্যান্য রোগীদের মতো করোনা ভাইরাস আক্রান্তদেরও চিকিৎসা করা সম্ভব হবে৷ তৃতীয় প্রচেষ্টার লক্ষ্য হলো, প্রচলিত কোনো ওষুধ দিয়েই করোনার রোগীদের চিকিৎসার করা৷ যেমন এবোলা বা এইডসের ওষুধ নির্দিষ্ট কিছু করোনা রোগীর উপর প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি৷ জাতীয় সংকীর্ণ স্বার্থে অথবা মুনাফার লোভে বিচ্ছিন্ন গবেষণা বিশ্বজুড়ে বর্তমান সংকট কাটাতে মোটেই সহায়ক হবে না৷ লাল ফিতের ফাঁস এড়িয়ে গবেষণার সুফল দ্রুত গোটা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে তবেই এই সংকট কাটানো সম্ভব হবে৷
করোনাবিরোধী যুদ্ধে বিজ্ঞান
03:10
বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন৷ ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে সম্ভবত কভিড-১৯ সংক্রমণ এড়ানো যেতে পারে৷ এ ক্ষেত্রে সার্স ও মার্সের মতো অন্যান্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন৷ গবেষক দলের সদস্য আন্দ্রেয়া গামবটো বলেন, এই দুই ভাইরাসের মতে কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও স্পাইক প্রোটিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা রাখে৷ তাই এভাবেই কভিড-১৯-কে কাবু করার চেষ্টা চালাতে হবে৷
পিটসবার্গে ইঁদুরের উপর ‘পিটকোভ্যাক' নামের যে পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেটি মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে অসংখ্য অ্যান্টিবডি গড়ে তুলেছে৷ তবে সেই প্রাণীগুলির উপর দীর্ঘ সময় ধরে নজর না রাখলে প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়৷ মার্স ভাইরাসের পরীক্ষামূলক টিকার ক্ষেত্রে এক বছর পর্যন্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট ছিল৷ আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কভিড-১৯ প্রতিষেধক পরীক্ষামূলকভাবে মানুষের উপর প্রয়োগের আশা করছেন গবেষকেরা৷
এদিকে জাপানের ফুজিফিল্ম কোম্পানি অ্যাভিগান নামের নিজস্ব ওষুধ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় কতটা সক্ষম, তা পরীক্ষা করতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেছে৷ উল্লেখ্য, চীনে এই ওষুধ করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বলে খবর পাওয়া গেছে৷ অনেকের ক্ষেত্রে দ্রুত আরোগ্য লক্ষ্য করা গেছে৷ কমপক্ষে ১৪ দিন পরীক্ষার পর এই ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যাবে৷ কোম্পানির এক মুখপাত্র বলেন, জুন মাসের শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন রোগীর উপর এই ওষুধের প্রভাব পরীক্ষা করা হবে৷
প্রবল চাপের মুখে টিকা ও ওষুধ নিয়ে গবেষণার কার্যকারিতা সম্পর্কেও কিছু সংশয় দেখা যাচ্ছে৷ কারণ গোটা বিশ্বের ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা এখনো কভিড-১৯ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারেন নি৷ এমনকি এই ভাইরাসের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁরা বিভ্রান্ত৷ বিশেষ করে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের শরীরে এই ভাইরাস সামান্য বা কোনো লক্ষণই দেখা না যাওয়ায় বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত বিস্মিত৷ ফলে কভিড-১৯ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ছাড়াই টিকা বা ওষুধ কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্নও বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে৷
এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷