কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি' আর চলবে না
১৮ মে ২০১৮এককভাবে কংগ্রেসের পক্ষে তা আর সম্ভব নয়৷ সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলি সম্পর্কে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দলটিকে৷
সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের দু'টি উপ-নির্বাচন দিয়ে শুরুটা হয়েছিল৷ তারপর ভারতের আরও দুই রাজ্য গুজরাট ও কর্ণাটক৷ একক ক্ষমতায় বিজেপিকে রুখতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস৷ বলা ভালো, পরীক্ষিত সত্য প্রমানিত হয়েছে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলে একক ক্ষমতায় কোনওভাবেই বিজেপিকে হটাতে পারবে না কংগ্রেস৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী জান-প্রাণ এক করে লড়াইয়ের চেষ্টা করেও গুজরাট বা কর্ণাটকে জনাদেশ আদায় করতে পারেননি৷ এই আবহে জাতীয় স্তরে বিজেপিবিরোধী ‘ফেডারেল ফ্রন্ট' গড়ার উদ্যোগ আরও গতি পাচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে৷ বাংলার নেত্রীর সেই তত্ত্ব হলো, ‘একের বিরুদ্ধে এক' লড়াই৷ অর্থাৎ, আগামী লোকসভা নির্বাচনে(২০১৯) বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসকে তার ‘ইগো' ঝেড়ে ফেলে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতেই হবে৷ সেক্ষেত্রে যে দল যেখানে শক্তিশালী, তাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে৷ বাংলায় সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রায় ৯০ শতাংশ আসনে জয় মমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে৷ একইভাবে অন্ধ্রপ্রদেশে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তেলুগু দেশম পার্টি৷ তেলেঙ্গানায় টিআরএস৷ তামিলনাড়ুতে ডিএমকে৷ বিহারে আরজেডি৷ সর্বত্র ক্ষমতা হারিয়ে দুর্বল হচ্ছে কংগ্রেস৷ বলা যেতেই পারে, দীর্ঘ কয়েক দশক পরে আবার জোট সরকারের দিকে এগোচ্ছে ভারত৷
রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জি মনে করেন, বিজেপিবিরোধী ঐক্যে মমতা ব্যানার্জিই প্রাণকেন্দ্র৷ মমতা ব্যানার্জি আর শুধু বাংলার নেত্রী নন৷ তাঁকে কেন্দ্র করে দেশের বিজেপিবিরোধী রাজনীতি উত্তাল ও আলোড়িত হচ্ছে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস থেকে সিপিএম, সবাইকে তা উপলব্ধি করতেই হবে৷ কর্ণাটকের নির্বাচনী ফল এর প্রসঙ্গ তুলে ধরে ঋতব্রত বললেন, ‘‘কর্ণাটকের নির্বাচন একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার করে দিয়েছে, তা হলো, দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতাই মমতা ব্যানার্জির মতো মানুষের মন বোঝেন না৷ মমতাকে ঘিরেই জাতীয় স্তরে আবর্তিত হচ্ছে বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলো৷ দানা বাঁধছে ঐক্য৷ কর্ণাটক বুঝিয়ে দিয়েছে, বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ‘ওয়ান-ইজটু-ওয়ান' সূত্রই একমাত্র পথ৷''
শুরুর দিকে কিছুতেই এই তত্ত্ব মানতে চাননি রাজধানী দিল্লির রাজনীতিকরা৷ এমনকি কেন্দ্রীয় স্তরে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মমতার এই তত্ত্বকে হেয় পর্যন্ত করা হয়েছে৷ কিন্তু বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ স্তরে এবং প্রধান চর্চার বিষয় যে কর্ণাটক, সেখানে দেরিতে হলেও মমতার দেখানো পথেই হাঁটতে হলো রাহুল গান্ধীর দলকে৷ অথচ নির্বাচনের আগে জেডি(এস)-এর হাত ধরলে অন্যরকম হতে পারতো ভোটের ফলাফল৷
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্ণাটক পরবর্তী সময়ে রাহুল গান্ধীর সামনে আরও এক দফা সুযোগ রয়েছে৷ তা হলো, ২০১৯-কে ‘পাখির চোখ' করে এই বছরের শেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোর দিতে হবে৷ তিন রাজ্যেই সরকারবিরোধী হাওয়া বইছে৷ এই তিন রাজ্যেই রাহুলকে লড়তে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের সঙ্গে৷ পাশাপাশি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ভোট-ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও লড়তে হবে তাঁকে৷ এই দুই ক্ষেত্রেই রাহুলের এখনও পাশ মার্ক জোটেনি৷ তাহলে ওই তিন রাজ্যের ক্ষেত্রে কৌশল কী হবে তা জানা নেই কংগ্রেসের৷ ভরসা হতে পারে মমতা ব্যানার্জির দেখানো পথ৷ যে পথে হেঁটেই কর্ণাটকে জেডি(এস)-কে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছে কংগ্রেস৷
এক্ষেত্রে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান' লড়াইয়ের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন, সেই দিকটিও ভাবতেই হবে রাহুলকে৷ কর্ণাটক নির্বাচন থেকে সম্ভবত সেই শিক্ষা নিয়েছে কংগ্রেস৷বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের মতো বড় রাজ্যগুলিতে বিরোধীদের জায়গা ছাড়তেই হবে তাঁকে৷ যেখানে কংগ্রেসের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী অন্যান্য দল৷ নচেৎ কংগ্রেসকে আটকে থাকতে হবে পাঞ্জাব, মিজোরাম ও পুদুচেরির মতো রাজ্যেই৷ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী তিন রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিকে হঠাতে ভোটের আগেই আঞ্চলিক দলগুলিকে রাজনৈতিক জমি ছেড়ে দিতে হবে কংগ্রেসকে৷ কর্ণাটকে বিপদে পড়ে জেডিএসকে সমর্থনের কৌশলই ২০১৯-এ কংগ্রেসের প্রধান রণকৌশল হতে পারে৷ আর যদি এমনটা করতে না পারেন, তাহলে লোকসভায় আবারও হতাশ হতে হবে রাহুল ও তাঁর দল কংগ্রেসকে৷
প্রায় চার দশক ধরে দেশের রাজনীতির অলি-গলি ঘুরে সাংবাদিকতা করেছেন ষাটোর্ধ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা৷ আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলির এক ছাতার তলায় আসা-না আসা প্রসঙ্গে তাঁর মত হলো, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং শেষমেশ কর্ণাটকের ভোটের ফলে রাহুলের গ্রহণযোগ্যতা মোটেও প্রমাণ হয়নি৷ আসলে রাহুল গান্ধীকে বুঝতে হবে, বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে ইগোর কোনো জায়গা নেই৷ মমতা ব্যানার্জির ফর্মুলা বেশ কার্যকরী৷
শরদের কথায়, ‘‘উত্তরপ্রদেশে তিন দশক ক্ষমতায় নেই কংগ্রেস৷ পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, বিহারসহ অন্যান্য রাজ্যেও আঞ্চলিক দল অনেক শক্তিশালী হচ্ছে৷ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কর্ণাটক নির্বাচনে অত্যন্ত খারাপ ফল করেছে কংগ্রেস৷ রাজ্যে সরকারবিরোধী হাওয়া না থাকা, রাহুল গান্ধীর একটানা প্রচার, এমনকি রাজ্যে অন্যতম প্রভাবশালী মুখ হিসেবে সিদ্দারামাইয়া থাকা সত্ত্বেও দলের এমন হাল নিয়ে বেশ চিন্তায় দলের শীর্ষ নেতারা৷ গত নির্বাচনের তুলনায় ৪৪টি আসন কম পেয়েছে কংগ্রেস৷ আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮টিতে৷ সমীক্ষা বলছে, জেডিএসের সঙ্গে প্রাক-নির্বাচনী জোট করে লড়াই করলে ৫৪ শতাংশের বেশি ভোট পেতো কংগ্রেস-জেডিএস৷ আসন সংখ্যার নিরিখে যা বিজেপির থেকে অনেক বেশি হতো৷ ফলে, বোঝাই যাচ্ছে উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যে গলদ থেকে গেছে কংগ্রেসের৷ রাহুলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না৷''
কংগ্রেস নেতারা যা নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তা হলো, গতবারের তুলনায় প্রায় এক শতাংশ ভোট বেড়েছে দলের৷ ২০১৩ সালে ১২২টি আসনে জিতে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিল ৩৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ৷ এবার মাত্র ৭৮টি আসন দখল করে প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৮ শতাংশ৷ কিন্তু গুজরাটেও তো বিজেপির ভোট বেড়েছে৷ কাজেই এই যুক্তিও খাটছে না৷
এতকিছুর মধ্যে পরিবারতন্ত্র নিয়ে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করতে ময়দানে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ বলেছেন, ‘‘রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের দিন শেষ৷ এখন মানুষ কঠোর পরিশ্রমে ভরসা রাখছে৷''
এই বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷