1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা

ফয়সাল শোভন
৩ মে ২০১৯

ক্রান্তিকাল পার করছেন বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা৷ কর্মসংস্থান ও পেশা নিয়ে হতাশ তাঁরা৷ এ হতাশা শেষ পর্যন্ত তাঁদের স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংবাদকর্মীরা৷

ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain

আর ঠিক একমাস পরই প্রিয় কর্মস্থল ছেড়ে দিতে হবে তাঁদের৷ এক-দু'জন নন, কম করেও ২০০ জন৷ ১৬০ জন কাজ করছেন ঢাকা অফিসে, জেলা প্রতিনিধি আছেন ৭৪ জন৷  চালুর সাড়ে ৫ বছরের মাথায় এসে সংবাদ বিভাগ গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চ্যানেল নাইন এর কর্তৃপক্ষ, যা একটি নোটিশ টানিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে কর্মীদের৷  ৪ মাসের বকেয়া বেতন তাঁরা পাবেন কিনা তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা৷  চ্যানেলটির একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংবাদকর্মী বলেন, ‘‘শুরু থেকে কখনোই আমরা নিয়মিত বেতন পাইনি৷ বেতন দেয়ার কোনো নির্দিষ্ট তারিখও ছিল না৷ কোনো সরকারি ছুটি ছিল না, আলাদা করে তার টাকাও দেয়া হতো না৷ ৫ বছরে দুইবার ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে, তাও নামকাওয়াস্তে৷ এখন এমনকি কোনো লেটার বা স্যালারি সার্টিফিকেট কিছুই দেয়া হচ্ছে না৷’’

শুধু চ্যানেল নাইন নয়, অন্য অনেক টেলিভিশন চ্যানেলগুলের কর্মীরাই কম-বেশি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন৷ অনেকে র্দীঘদিন বেতন পাচ্ছেন না৷ শ্রম আইন অনুযায়ী বাকি সুযোগ-সুবিধা তো আরো দূরের বিষয়৷

কথা হচ্ছিল দেশ টিভির একজন সংবাদ কর্মীর সাথে৷ তিনি জানান, ৪ মাসের বেশি সময় ধরে কোনো বেতন দেয়া হচ্ছে না সেখানে৷ এর মধ্যে মে দিবসের ঠিক আগের দিন পঁচিশ থেকে ত্রিশজন কর্মীকে ডেকে কর্তৃপক্ষ চাকুরি ছাড়তে বলেছেন৷ কারণ, বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে তাঁরা এর আগে প্রশাসনকে চাপ দিয়েছিলেন৷ ওই সংবাদকর্মী জানান, বেশ কয়েকজন এর মধ্যেই চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷

সম্প্রচার মাধ্যমের চাকরির নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে: রেজোয়ানুল হক

This browser does not support the audio element.

এমন কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে আরো কয়েকটি টেলিভশন চ্যানেল থেকে৷ গত ৪ মাসে ২৫ জনের বেশি কর্মী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাছরাঙা টেলিভিশন থেকে, যাঁদের মধ্যে ১২ জন শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে৷ কর্মী ছাঁটাই করেছে শুরুর দিককার টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলাও৷  গত এক মাসেই ১৪ জন সংবাদকর্মী ও অনুষ্ঠান বিভাগের ৩৫ জনকে বিদায় করা হয়েছে বলে জানা গেছে সেখানে কর্মরত এক সংবাদকর্মীর কাছ থেকে৷ 

পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের নতুন সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক বলেন, ‘‘একটি মিক্সড চ্যানেল তাদের নিউজ ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে৷ আরো কেউ কেউ করতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে৷ অনেক প্রতিষ্ঠানের বেতনই নিয়মিত হচ্ছে না৷ অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতনের বাইরে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকে, যেমন ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট, সেটি বহুদিন ধরে বন্ধ৷ এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাইও চলছে৷ সব কিছু মিলিয়ে আমাদের সম্প্রচার মাধ্যমের চাকরির নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷’’

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বলছেন শহিদুল আলম

00:40

This browser does not support the video element.

ভালো নেই সংবাদপত্রের কর্মীরাও

স্বস্তিতে নেই সংবাদপত্রের কর্মীরাও৷ সম্প্রতি দেশের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো থেকে প্রায় ২৫ জন কর্মীকে বিদায় নিতে হয়েছে৷ দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত এই গণমাধ্যমটির উদাহরণ টেনে অনেকেই পরিস্থিতি কতটা সঙ্কটের তা পরিমাপ করছেন৷  দেশের সবচেয়ে পুরাতন সংবাদপত্রগুলোর একটি ইত্তেফাকেও মাঝে মধ্যেই ছাঁটাই হয় বলে জানান সেখানকার এক কর্মী৷ নতুন ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন হলে কর্মীদের বেতন বেশি দিতে হবে, এ কারণে গত তিন বছরে প্রায় ৫০ জনের চাকরি স্থায়ী থেকে চুক্তিভিত্তিক করেছে প্রতিষ্ঠানটি৷ গত ২ মাসে প্রায় ২৫ জনকে এই প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে৷ 

গেল বছরের ডিসেম্বরে ২৬ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন দৈনিক জনকণ্ঠের কর্মীরা৷ এছাড়া বেশিরভাগ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধেই রয়েছে কর্মীদের বেতন প্রদানে ঘোষিত ওয়েজ বোর্ড অনুসরণ না করা এবং নিয়মিত বেতন না দেয়ার অভিযোগ৷

‘‘সংবাদপত্রই বলেন, আর টেলিভিশনই বলেন, তাদের মাঝে কস্ট কাটিং করার একটি প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি৷ যেটি সাংবাদিকদের চাকুরির উপর আঘাত হানছে,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম৷

কেন এই অবস্থা

সব মিলিয়ে কতজন সংবাদকর্মী সাম্প্রতিক সময়ে চাকরি হারিয়েছেন সে বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সংগঠনগুলোর কাছে৷ তবে সংখ্যাটি শতাধিক হবে বলে মনে করেন সাইফুল আলম৷ তিনি বলেন,  বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে৷ ‘‘টেলিকম এবং হাউজিং খাতের বিজ্ঞাপন একেবারেই কমে গেছে, যেটি মূল বিজ্ঞাপনের ষাট ভাগ ছিল একসময়৷ অনেকগুলো পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন হয়েছে, যে কারণে বিজ্ঞাপন ভাগ হয়ে গেছে,’’ বলেন সাইফুল আলম৷

কস্ট কাটিং করার একটি প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি: সাইফুল আলম

This browser does not support the audio element.

সরকারি হিসেবে দেশে আড়াই হাজারের বেশি সংবাদপত্র রয়েছে যার ১২৪৮ টি দৈনিক৷ চালু রয়েছে ৩৩ টি টেলিভিশন চ্যানেল, প্রচারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে আরো অন্তত ৫টি৷ সেই সঙ্গে নতুন লাইসেন্সের আবেদনও করেছেন অনেকে৷ 

মাছরাঙা টেলিভিশনের র্বাতা বিভাগের প্রধান রেজোয়ানুল হক বলেন, বেসরকারি খাতের টেলিভিশনের আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন৷ গ্রাহকরা ক্যাবল অপারেটরদের প্রতি মাসে যে ফি দেয়, তার কোনো অংশই টেলিভিশন চ্যানেল পায় না৷ তার উপর গত কয়েক বছরে বিজ্ঞাপন ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে৷ তিনি বলেন, ‘‘বিদেশি চ্যানেল যেগুলো আমাদের দেশে দেখা যায়, সেখানেও অনেক দেশি বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে৷ আইন ভঙ্গ করেই এই কাজটি বহুদিন ধরে করা হচ্ছে৷ নতুন নতুন ডিজিটাল প্লাটফর্মেও বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে, যার কারণে সব মিলিয়ে বিজ্ঞাপন থেকে অর্জিত আয় কমে গেছে৷ ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় কর্মীদের যে ঝুঁকিটা আমরা দেখছি তার মূল কারণ মূলত এই আয় কমে যাওয়া৷’’

সমাধান কী

এই পরিস্থিতির খুব দ্রুত কোনো সমাধান দেখছেন না সাংবাদিক নেতারা৷ সাইফুল আলম বলেন, ‘‘সামনে আরেকটি ওয়েজ বোর্ড আসছে, সেটি নিয়েও সাংবাদিকরা অগ্রসর হচ্ছে৷ কিন্তু বিষয়টি কীভাবে সুরাহা হবে, আমরা এখন পর্যন্ত তার পথ পাইনি৷’’ এই পরিস্থিতিকে দেশের গণমাধ্যমের জন্য দুঃখজনক অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘‘এখান থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, তা নিয়ে সম্পাদক পরিষদ থেকে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও আলাপ-আলোচনা চলছে৷’’

সংকট উত্তরণে টেলিভিশনের জন্য আয়ের উৎস সন্ধানে নেমেছেন সম্প্রচার সাংবাদিকরাই৷ ১২০০ সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার এ ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান রেজোয়ানুল হক৷ বিদেশি চ্যানেলে দেশি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, ক্যাবল অপারেটরদের সাথে টেলিভিশন চ্যানেলের আয় ভাগাভাগি, এমন নানা বিষয় নিয়ে তারা সরকার, মালিকসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করছেন৷ ‘‘উদ্যোগগুলো যদি পরিণতি পায়, তাহলে কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে,’’ বলেন রেজোয়ানুল৷

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর প্রভাব

কর্মসংস্থানের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সাংবাদিকরা কতটা পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ বিষয়ে ফেসবুকে করা এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাভিশন-এর স্টাফ রিপোর্টার আরিফুল হক বলেন, ‘‘আমার চাকরি আছে, এই নিশ্চয়তা থেকেই তো আমি আগামীকালের জন্য আমার কাজের পরিকল্পনা করবো৷ যদি এই নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে কি কাজ করা যাবে?’’ দৈনিক কালের কণ্ঠের ফিচার বিভাগের সহ সম্পাদক মুহম্মদ খান মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমাদের মতো দেশে সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা৷ ব্যাক্তিগত আক্রোশেরও শিকার হতে হয় অনেক সময়৷ আইডেনটিটি না থাকলে তখন ঝুঁকি বেড়ে যায়৷’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশ টিভিতে কর্মরত এক সংবাদকর্মী বলেন, এই রুগ্ন পরিস্থিতিটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে গণমাধ্যম শক্তিশালী হতে না পারে৷ তিনি বলেন, দিনের পর দিন বেতন না পাওয়া, সহকর্মীদের কাজের প্রতি অনীহা সব মিলিয়ে এই পেশার প্রতি কোনো দরদ তিনি বোধ করেন না৷ অফিসের অসহযোগিতার কারণে ভালো কাজ করাও সম্ভব হয় না৷   

চাকুরির অনিশ্চিয়তার সাথে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক আছে এমনটা মনে করেন না সাংবাদিক রেজোয়ানুল হক৷  তবে তাঁর মতে, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান দুর্বল অবস্থায় থাকে, তখন শক্ত অবস্থান নিয়ে সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ ‘‘যখন আপনার নিজস্ব শক্তি থাকে না, আপনি দুর্বল থাকেন, তখন স্বাধীনভাবে সবকিছু করা সম্ভব না-ও হতে পারে,’’ বলেন তিনি৷

সাইফুল আলম মনে করেন, অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত হলেই মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত করা সম্ভব না৷ এর সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানও জরুরি৷ ‘‘সামগ্রিকভাবে বসে আমাদের ঠিক করতে হবে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়া এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা এ দুটি একসঙ্গে কীভাবে করা যায়,’’ বলেন জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি৷

ফয়সাল শোভন ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷@FaisalShovon14
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ