নারীর যৌন হয়রানি : অভিযোগের হিমশৈল, প্রকাশ্যে শুধু চূড়া?
১৪ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলার পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে তোলপাড় চলছে৷
কাছাকাছি সময়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বিভাগীয় এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দাখিল করেন। পরে ওই শিক্ষককে বিভাগীয় সকল কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করা হয়। যৌন নিপীড়ন সেল বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছে।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন সেল থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে এমন সেল গঠন করা হয়নি। ফলে অভিযোগ করার জায়গাই নেই। তাই অধিকাংশ সময় অভিযোগ জানানোর সাহস পান না ভুক্তভোগীরা।
ক্রীড়াঙ্গনে যৌন হয়রানি : উঁচু হয় অভিযোগের পাহাড়
জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম সম্প্রতি নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিসিবি। তবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হাইকোর্টের নীতিমালাই মানা হচ্ছে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নীতিমালা অনুযায়ী, নিয়োগকর্তা ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশনা আছে তাতে, যার অধিকাংশ সদস্য হবেন নারী। হয়রানির শিকার হওয়া খেলোয়াড়েরা কমিটির কাছে অভিযোগ করবেন, কমিটি অভিযোগ তদন্ত করবে।
কিন্তু ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো বড় ফেডারেশনসহ বাংলাদেশের ৫৩টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কোনোটিতেই নেই অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি। ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্রেও এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই। কোনো অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন তা তদন্ত করে, কখনো কখনো শাস্তিও হয়। তবে সেটি নিয়মিত প্রক্রিয়া নয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, "বিসিবিতে নতুন মানবসম্পদ কাঠামো হচ্ছে। তাতে সরকারি নিয়মে সব কিছুই থাকবে।”
কিন্তু কালের কন্ঠ পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক মাসুদ পারভেজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন যে অভিযোগগুলো সামনে আসছে সেগুলো আসলে ২০২১-২০২২ সালের ঘটনা। তখন ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চাননি, এখন তারা কথা বলতে শুরু করেছেন। জাহানারা পর রোমানা এবং এখন কোচ হিসেবে কাজ করছেন রেশমা আক্তার আদুরি - তারা কিন্তু ইতিমধ্যে অভিযোগগুলো করেছেন। আরো অনেকেই অভিযোগ করার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ হয়তো আরো অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তারাও তাদের হয়রানি বা এই নির্যাতনের কথাগুলো বলতে চান। আবার অনেকে অভিযোগ করতে চান, কিন্তু তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না, এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে।"
বিসিবি থেকে কয়েকজনকে ওএসডি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, "আসলে প্রচার হয়েছিল যে, জাতীয় দলের ফিজিও সুরাইয়া, কোচ ইমন, কো-অর্ডিনেটর সরফরাজ বাবু এবং ম্যানেজার ফাইয়াজকে ওএসডি করা হয়েছে। পরে অবশ্য বিসিবি জানিয়েছে যে, না. কারোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া এখন পর্যন্ত হয়নি। ফলে, তারা দলের সঙ্গে কাজ করছেন। এই মুহূর্তে বিকেএসপিতে মেয়েদের একটা টুর্নামেন্ট চলছে। সেখানে গিয়ে তারা মেয়েদেরকে চাপ সৃষ্টি করছেন বলে কয়েকজন অভিযোগ করেছেন ইতিমধ্যে। বিশেষ করে নিগার সুলতানা জ্যোতির বিরুদ্ধে ছোট ছোট মেয়েদের, যারা সেখানে খেলছেন, তাদের ফোন চেক করার অভিযোগও করেছেন অনেকে।"
বিসিবি যে তদন্তটি শুরু করেছে সেটা কতটা স্বচ্ছ বা নিরপেক্ষ হচ্ছে - এ প্রশ্নের জবাবে মাসুদ পারভেজ বলেন, "এই তদন্ত শুরুতেই তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল দাবি করেছিলেন যে, এই কমিটিতে বিসিবির যেন কাউকে রাখা না হয়। তারপরও কিন্তু বিসিবির একজনকে রাখা হয়েছে। এখানে নানা ধরনের প্রভাবের ঘটনাও ঘটছে বলে আমরা জানতে পারছি। ফলে এই তদন্ত থেকে যে সঠিক চিত্রটা উঠে আসবে, সেটা মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন প্রভাবশালী পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম কিন্তু এই ঘটনায় অভিযুক্ত। তিনিসহ জাতীয় দলের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উঠেছে, তারা কিন্তু সবাই তাদের নিজস্ব দায়িত্ব পালন করছেন। এখন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের যদি সাময়িকভাবেও অব্যাহতি দিয়ে বাইরে রাখা হতো, তাহলে হয়তো তদন্তটি সঠিকভাবে হতে পারতো। কিন্তু তারা কাজে থাকার কারণে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তারা এখন পর্যন্ত স্বপদে থেকে নানা রকম কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন।"
যৌন হয়রানির অভিযোগ ও বিচার
বাংলাদেশে যৌন হয়রানির মোট অভিযোগের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বিচার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই কমপক্ষে ১১ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি, ২০২৩ সালে ১৪২টি।
দৈনিক দেশ রুপান্তর-এর সিনিয়র রিপোর্টার তাপসী রাবেয়া আখি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সামনে যে অভিযোগগুলো আসে, সেটা মোট ঘটনার ২০ ভাগও না। এখনও গণমাধ্যমে নারীদের কর্ম পরিবেশ মসৃণ হয়নি। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আপনি যার কাছে অভিযোগ করবেন, তিনিও পুরুষ। ফলে, ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় থেকে যায়।'' তিনি আরো বলেন, ‘‘এই ভয়ে নারী কর্মীরা অভিযোগ করতে সাহস করেন না। অধিকাংশ অফিসে যৌন নিপীড়ন সেলই তো নেই। কিছু ঘটনার বিচার হলে নারী কর্মীদের কর্মপরিবেশ ভালো হতো।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং ‘অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ' পরিচালিত ২০২০ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ নারী কর্মী শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ নারীর কর্মস্থলে যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী উন্নয়ন ফোরাম এবং অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ-এর করা জরিপ বলছে, প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী তাদের সহকর্মী বা সুপারভাইজারের কাছ থেকে অশ্লীল মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণের শিকার হয়েছেন। প্রায় ৪০ শতাংশ নারী কর্মী জানিয়েছেন, তাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানালে কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নেয় না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির মামলার মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচার হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীরা হয়রানির শিকার হন বা তাদের মামলা দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রভাবহীন হয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির চিত্র
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ২০২১ সালে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত ১৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টি, অর্থাৎ ৬১ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭টি। ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ, ৩৯ শতাংশ কোনো অভিযোগ কমিটি গঠন করেনি। এর আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছিল। তথ্য দেওয়া ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ বাক্স নেই। গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২৮ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ কমিটি মোট ৯৯টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছে।
সেই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্লাস্ট-এর বোর্ড মেম্বার তাহমিনা রহমান। গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন ব্লাস্ট-এর গবেষণা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আনবার আনান তিতির। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে দুজনই বলেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তারা ঠিকমতো সহযোগিতা পাননি। বহুবার মেইল ও ফোন করে তথ্যগুলো নিতে হয়েছে। এসব তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিহা কাজ করেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণায় দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্রীর ওপর ২০২২ সালের অক্টোর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ওই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গবেষণার শিরোনাম "স্ট্র্যাটেজিস ফর প্রিভেন্টিং মাসকুলিনিটি অ্যান্ড জেন্ডার বেজ্ড ভায়োলেন্স ইন হায়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি”।
গবেষণায় অংশ নেওয়াদের দেওয়া তথ্য মতে, ৫৬ শতাংশ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানো হয় বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি পাঁচ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।
ইস্টার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী তাহমিনা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু চিত্রটা একরকম নয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নেন। যেমন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানে কিন্তু এই ধরনের অভিযোগকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় এবং ব্যাবস্থাও নেওয়া হয়।”
উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে অনাগ্রহ?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সব ধরনের কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। ২০১১ সালে এই রায়ের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট আদেশটি বহাল রাখেন। আদালত থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়নের চিত্র মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।
হাইকোর্টে এই রিটটি করেছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমরা যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায়টি পেলাম, তখন কিন্তু বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করেছিল। আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানই জানে না, সুপ্রিম কোর্টের রায়ই আইন। এই আইন বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্ব। রায়ের ১৪ বছর পরও এটা নিয়ে সরকার কোনো আইন করেনি। ভারতে কিন্তু ২০১৪ সালেই এ বিষয়ে আইন হয়েছে। অথচ আমরা আজ পর্যন্ত কোনো আইন করতে পারেনি।”
গণমাধ্যমেও যৌন হয়রানির অভিযোগ
কিছুদিন আগে ‘ঢাকা স্ট্রিম' নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের একজন নারী সাংবাদকর্মী আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার পর সামনে আসে নারী কর্মীরা অফিসের পুরুষ সহকর্মী আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৬) নামে একজন সংবাদকর্মী আত্মহত্যা করার পর অভিযোগ ওঠে যৌন হয়রানির অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার না পাওয়ার কারণেই আত্মঘাতী হয়েছেন তিনি।
আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চাকরি হারিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষানবীশ রিপোর্টার উর্মি শর্মা। অভিযোগকারী ৭ জন নারীর একজন উর্মি। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, "আমরা একেবারেই নিরুপায় হয়ে অভিযোগ করেছিলাম। কারণ, আলতাফ শাহনেওয়াজের আচরণ আমরা আর নিতে পারছিলাম না। সবার সঙ্গেই তিনি খারাপ আচরণ শুরু করেছিলেন। তার চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই ছিল নারীর জন্য অস্বস্তিকর। অভিযোগ দেওয়ার পর সম্পাদক আমাদের সঙ্গে একবারও কথা বলেননি। তাকে নিউজরুম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সত্যি, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তাকে আরও বেশি ক্ষমতা দিয়ে অফিসে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে তার আচরণ ছিল আরো বেপরোয়া। পরেও তিনি নানা বিষয়ে আমাদের ডেকে কথা বলতেন, যেটা হওয়ার কথা ছিল না।”
এমন অসংখ্যা ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে কতটুকু? শাস্তি হচ্ছে কতজন যৌন নিপীড়কের? আদৌ কি নারীরা হয়রানির কথাগুলো বলতে পারছেন? অধিকারকর্মী খুশি কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা কথাগুলো সামনে আনতে পারছেন না। কর্মক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নিচু পদের নারী বা একটু দুর্বল চিত্তের নারীরা এই ধরনের হয়রানির শিকার বেশি হন। তাদের টার্গেট করেই উচ্চ পদের পুরুষ সহকর্মীরা যৌন হয়রানি করে থাকেন, যাতে তারা চাকরির ভয়ে অভিযোগ করতে না পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়গুলো সামনে আসে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরো দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে।”
গণমাধ্যমে নারী কর্মীরা যৌন হয়রানির অভিযোগ করে কতজন বিচার পেয়েছেন কতজন? উত্তর - একজনও না। অর্থাৎ, একটা ঘটনারও বিচার হয়নি। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লেখালেখিতেই শেষ হয়েছে সব। ‘ঢাকা স্ট্রিম'-এর এক কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমে নারীদের কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্নটি আবার বড় হয়ে ওঠে। অথচ এ বিষয়ে তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। কিন্তু কেউ মানছে না সেই আদেশ। আইন বাস্তবায়নেও সরকারি-বেসরকারি কোনো তরফেই উদ্যোগ নেই।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "গণমাধ্যম তো সমাজের বাইরের কিছু না। গোটা দেশেই যেখানে সুশাসনের অভাব রয়েছে, সেখানে গণমাধ্যমের কাছ থেকে পৃথক কিছু আশা করতে পারি না। দেশে যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন গণমাধ্যমেও পরিবর্তন আসবে। আদালত থেকে সিদ্ধান্ত এলে সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু কোনো সরকারই গণমাধ্যমে যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কমিটি গঠন করতে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের পথে হাঁটেনি। এখনও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।”
দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "আদালতের যে আদেশ রয়েছে, সেটা বাস্তবায়নে প্রেস কাউন্সিল ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আদালত থেকে অনেক আদেশই আসে, অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয় না। গণমাধ্যমে আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য কেউ তো তদারকি করছে না। সেই তদারকিটা প্রেস কাউন্সিল করতে পারে।”
বর্তমানে গণমাধ্যমে নারী কর্মীদের কাজের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে একাত্তর টেলিভিশন-এর বিশেষ প্রতিনিধি শাহনাজ শারমীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুঃজনক হলো, ৩০টি টেলিভিশনের মধ্যে মাত্র তিনটি টেলিভিশনে এই কমিটি আছে। অন্যগুলো নেই। অর্থাৎ, হাইকোর্টের এই আদেশের বাস্তবায়ন হয়নি। আমি এমআরডিআইতে গণমাধ্যমের নারী কর্মীদের কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করি। সেখানে অনেক নারী সংবাদকর্মী আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু তারা অভিযোগ সামনে আনতে ভয় পান- যদি চাকরি চলে যায়? ফলে, যে অভিযোগগুলো সামনে আসছে তার চেয়ে গণমাধ্যমে যৌন হয়রানির ঘটনা অনেক বেশি।”
পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ কেমন?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, তৈরি পোশাক কারখানায় কমর্রত নারী শ্রমিকদের প্রতি চার জনের একজন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও শতকরা ৩৫ দশমিক ৩ ভাগ নারী কর্মী কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে যৌন হয়রানির ঘটনা শুনেছেন বা দেখেছেন। ঢাকার মিরপুর এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় অবস্থিত ২২টি পোশাক কারখানায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এতে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলোতে শতকরা ২২ দশমিক ৪ ভাগ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের যে ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কামনার দৃষ্টিতে তাকানো, যার হার ৪২ দশমিক ৩৩ ভাগ। এরপর সংবেদনশীল অঙ্গে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা, যার হার ৩৪ দশমিক ৯২ ভাগ। তারপর সংবেদনশীল অঙ্গের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো, যার পরিমাণ শতকরা ৩৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। কাজ বোঝানো বা কথা বলার সময় হাত বা শরীরের কোনো অংশে স্পর্শ করার হার শতকরা ২৮ দশমিক ৫৭ ভাগ। এছাড়াও আছে বাজে গালি দেয়া, চাকুরিচ্যুতির হুমকি, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদন্নোতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি। বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ পোশাক শিল্প থেকে আসে এবং এখানে কমর্রতদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ নারী। গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ও শতকরা ৭৯ শতাংশ পুরুষ এ সম্পর্কে জানেই না।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর ডিরেক্টর- ইনফ্লুয়েন্সিং (ক্যাম্পেইন ও কমিউনিকেশনস) নিশাত সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কর্মস্থলে নারীর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাটি ক্রমবর্ধমান। এই বাস্তবতাটির দুটো দিক রয়েছে। এর কারণ হতে পারে কর্মস্থলে নারীদের উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ফলে আনুপাতিক হারে বাড়ছে হয়রানির ঘটনা। আরেকটি দিক হতে পারে যৌন হয়রানি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। ফলে আগের তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তারপরও মনে রাখতে হবে, এই ধরনের ঘটনার অধিকাংশই পর্দার অন্তরালে রয়ে যায়। প্রকৃত ঘটনার এক চতুর্থাংশও সামনে আসে না।”