সম্প্রতি ইউরোস্ট্যাট নামক একটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর রিপোর্ট নিয়ে আলোড়ন ছড়িয়েছে জার্মানিতে৷ দেখা যাচ্ছে কর্মহীনতা এবং দারিদ্র্যের সূচকে জার্মানির অবস্থান বেশ সংকটে৷ শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোরও৷
বিজ্ঞাপন
আপাতদৃষ্টিতে জার্মানিকে ধরা হয় পৃথিবীর বিত্তশালী দেশগুলির অন্যতম৷ মাথাপিছু রোজগারের পরিমাণও এখানে যথেষ্ট বেশি৷ কিন্তু সম্প্রতি ‘ইউরোস্ট্যাট' নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের রিপোর্টে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে জার্মান সরকারেরও৷ রিপোর্টে প্রকাশ, জার্মানিতে কর্মহীন মানুষ ক্রমশ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে৷ শতাংশের নিরিখে সংখ্যাটি চিন্তায় ফেলার মতোই৷ ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ৷ বাকি ইউরোপে যা ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ৷
রিপোর্ট অনুযায়ী জার্মানির পরেই এই সমস্যায় ভুগছে লিথুয়ানিয়া৷ কিন্তু সেখানে কর্মহীন মানুষের দারিদ্র্যমার নীচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ৷ অন্যদিকে, এই সংকট অনেক কম ফ্রান্স, সাইপ্রাস কিংবা ফিনল্যান্ডে৷ সর্বত্রই শতাংশের অনুপাতে সংখ্যাটি হলো ৪০ শতাংশের নীচে৷ বস্তুত, ইউরোস্ট্যাট-এর মন্তব্য, সংখ্যাটি ৪০ শতাংশের নীচে থাকলে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই৷
ইউরোপের বস্তিগুলো
ইউরোপের শহরগুলোর বস্তিতে তিন কোটিরও বেশি মানুষের বাস৷ এসব বস্তিতে নেই বিদ্যুৎ ও পানির সুব্যবস্থা৷
ছবি: FILIPPO MONTEFORTE/AFP/Getty Images
অমানবিক অবস্থা
বেশিরভাগ বস্তিতে এক ছাদের নীচে অনেকে বাস করেন৷ মাত্র চার বর্গমিটার এলাকায় তিন জন মানুষ গাদাগাদি করে থাকে৷ নেই বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার বা নিরাপত্তা৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্যারিসের অন্য রূপ
ইউরোপের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাম রোমা৷ অভিজাত শহর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি বস্তির ছবি এটি৷ ইউরোপের বিভিন্ন শহরের বস্তিতে রোমাদের সংখ্যাটাই বেশি৷ এদের বেশিরভাগই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং বেকার৷
ছবি: DW/G. Ketels
ঘর হারানোর ভয়
আমাদের দেশের মতোই বেশিরভাগ বস্তি অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে৷ তবে প্রধান শহরগুলোতে কিছু বস্তি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত৷ রোমারা এসব বস্তিতে খুব আশঙ্কার মধ্যে থাকে, কেননা তারা শ্রেণি বৈষ্যমের শিকার এবং যে-কোনো সময় তাদের বের করে দেয়ার ভয় দেখানো হয়৷
ছবি: Pablo Blazquez Dominguez/Getty Images
প্রদীপের নীচে অন্ধকার
ইউরোপকে সবসময় ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এবং জীবনযাপনের জন্য ভালো স্থান বলে তুলে ধরা হয়৷ কিন্তু ফ্রান্স থেকে সার্বিয়া বা তুরস্ক সব জায়গাতেই কিন্তু বস্তি রয়েছে৷ ইউরোপের সবচেয়ে বড় বস্তিটি স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের কাছে অবস্থিত৷ ৪০ বছর আগে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে বাস করেন প্রায় ৩০,০০০ মানুষ৷
ছবি: DW
বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা
জাতিসংঘের মতে, ২০২০ সালের মধ্যে সাহারা অধ্যুষিত আফ্রিকায় মোট জনসংখ্যার ২৬.৬ শতাংশ বস্তিতে বাস করবে, যা বর্তমানের চেয়ে একটু বেশি৷ এশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৫৭.৭ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করবে৷ সেই তুলনায় ইউরোপের দেশগুলোতে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৩ শতাংশ মানুষ থাকবে বস্তিতে৷
ছবি: Mindjazz pictures
বৃত্ত থেকে বের হওয়ার উপায় নেই
বিশ্বের অন্যান্য বস্তির তুলনায় ইউরোপের বস্তিগুলোর মানুষ অবশ্য সুযোগ সুবিধা থেকে ততটা বঞ্চিত নয়৷ তবে বিশ্বের সব বস্তিতে একটা বিষয়ে মিল আছে আর তা হলো শিক্ষার আলো থেকে বস্তিবাসীরা বঞ্চিত৷ ফলে এরা কেউ এই দরিদ্রতা থেকে বেরিতে আসতে পারে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কণ্টকিত জীবন
ইউরোপের বস্তিগুলো কেবল রোমা সম্প্রদায় নয় অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাথা গোঁজার জায়গা৷ বিশেষ করে স্পেনে অর্থনৈতিক মন্দার পর অনেকেই বাসা ভাড়া এবং বাড়ি বন্ধকীর অর্থ শোধ করতে না পারায় বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছেন৷
ছবি: DW
গৃহহীন
ইটালির রাজধানী রোমের উপকণ্ঠে একটি শরণার্থী শিবিরে এই পরিবারটির বাস৷ আসলে একটা বস্তির আকার ও আয়তন কি হবে তা পরিমাপ করাটা কঠিন৷ তবে বরাবরই কর্তৃপক্ষ যা ঘোষণা করে তার চেয়ে বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে৷
ছবি: FILIPPO MONTEFORTE/AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
প্রশ্ন হলো, জার্মানিতে কেন এমনটা ঘটছে, যেখানে পরিসংখ্যান বলছে জার্মানির অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করছে! ইউরোস্ট্যাট-এর বক্তব্য, জার্মানিতে জিনিসের যা দাম, তার সঙ্গে কর্মহীন মানুষেরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না৷ মনে রাখা দরকার, জার্মানি এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশই ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র৷ কর্মহীন মানুষেরা এই দেশগুলিতে সরকারের কাছ থেকে অর্থসাহায্য পান৷ চাকরি যাওয়ার পর প্রাথমিক ভাবে জার্মানিতে বসবাসকারী মানুষেরা তাঁদের বেতনের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পান৷ সন্তান থাকলে তা ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া যায়৷ তবে ক্রমশ এই অর্থের পরিমাণ কমতে থাকে৷ বহুদিন কর্মহীন মানুষেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে মাসে ৪১৬ ইউরো পান৷ পাশাপাশি বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাও পান৷ কিন্তু মনে করা হচ্ছে, এই পরিমাণ অর্থ জার্মানিতে বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়৷ এবং সে কারণেই কর্মহীন গরিব মানুষেরা ক্রমশ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছেন৷
বহুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন একটি সমাজসেবী সংগঠনের সদস্য উলরিখ শ্নাইডার৷ তাঁর মতে, ২০০৫ সাল থেকে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে জার্মানি যে নীতি অবলম্বন করছে, তারই ফলাফল এটি৷ বস্তুত, অদূর ভবিষ্যতে সমস্যাটি আরো চরম আকার ধারণ করবে বলেই তাঁর বিশ্বাস৷ এবং এর জন্য আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকারকেই দোষ দিচ্ছেন তিনি৷ তাঁর বক্তব্য বিষয়টি খুবই জটিল৷ গত কয়েক দশকে জার্মানিতে বহুক্ষেত্রেই বেতনের পরিমাণ কমেছে৷ পাশাপাশি জীবনবীমার নিয়মকানুনও অনেক বদলেছে৷ যা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পরিপন্থি৷ এখন আর বিনামূল্যে চশমা তৈরি করা যায় না৷ চিকিৎসাক্ষেত্রেও গরিব মানুষ নানা অসুবিধার সম্মুখিন হচ্ছেন৷
পৃথিবীর লজ্জা: শত কোটি গরিবের সমান ৬২ জন বড়লোক!
বিশ্বে ধনীর সংখ্যা কমছে, কিন্তু বাড়ছে দরিদ্র আর দারিদ্র্য৷ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৬২ ব্যাক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের সমান!
ছবি: Colourbox/M. Shmeljov
পৃথিবীর লজ্জা
বিশ্বের মোট জনসংখ্যা এখন ৭৩০ কোটির মতো৷ এই ৭৩০ কোটির মধ্যে মাত্র ৬২ জনের টাকার জোরের কাছে বলতে গেলে সবাই-ই নত৷ সোমবার ‘এক শতাংশের অর্থনীতি’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে অক্সফাম জানিয়েছে, এ মুহূর্তে সবচেয়ে ধনী ৬২ ব্যাক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের সমান!
ছবি: picture-alliance/AP Images/B. Curtis
নিরন্নের আর্তনাদ, ধনকুবেরের আস্ফালন
বিশ্বে কোটি মানুষ এখনো অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে৷ সিরিয়ায় তিনটি মাস প্রায় না খেয়ে থেকেছে কত নারী, শিশু! ঠিক এই সময়েই অক্সফাম প্রকাশ করেছে এই প্রতিবেদন৷
ছবি: Aktivisten aus Madaja
ধনী কমছে, ধনীর ধন বাড়ছে
পাঁচ বছর আগে বিশেষ মাপকাঠিতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় যেখানে ছিল মোট ৩৮৮জন, একই মাপকাঠিতে সেই তালিকায় এখন স্থান পাচ্ছেন মাত্র ৬২ জন৷ এই হিসেব অনুযায়ী, ধনীর সংখ্যা যদিও কমছে, কিন্তু দরিদ্র মানুষ বা তাঁদের দারিদ্র্য কমছে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Jebreili
গরিব আরো গরিব
এ সপ্তাহেই দাভোসে বসছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ)-এর শীর্ষ সম্মেলন৷ গত বছর এই সম্মেলনের আগেই অক্সফাম জানিয়েছিল, বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে বিশ্বের এক শতাংশ ধনী৷ এবার অক্সফাম বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের সঙ্গে অন্যদের ব্যবধান এক বছরে অনেক বেড়েছে৷সাড়ে তিনশ কোটি দরিদ্র মানুষের মোট সম্পদ আগে যা ছিল তার চেয়ে শতকরা ৪১ ভাগ কমেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ধনীর ধনসম্পদ বেড়েই চলেছে
আরেকটি বিষয়ও বেরিয়ে এসেছে অক্সফাম-এর এই গবেষণায়৷ ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় স্থান পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৬২ জন বিলিয়নিয়ারের সম্পদের পরিমাণ ৪৪ শতাংশ বেড়েছে৷
ছবি: Colourbox/M. Shmeljov
5 ছবি1 | 5
বস্তুত, গার্ডিয়ান পত্রিকায় মাসখানেক আগে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল৷ সেখানে বলা হয়েছিল, ব্রিটেন সহ গোটা ইউরোপই কর্মহীনতা এবং দারিদ্র নিয়ে সংকটে৷ অক্সফোর্ডের কয়েকজন বাম মনোভাবাপন্ন অর্থনীতিকের একটি নতুন তত্ত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল সেই রিপোর্টে৷ যাঁদের বক্তব্য, সামাজিক সুরক্ষার অর্থ যদি খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়া যায় এবং যদি দেশের প্রত্যেকটি পরিবারের কাছে সামাজিক সুরক্ষার একটি অর্থ পৌঁছে দেওয়া যায় প্রতি মাসে, তাহলে দারিদ্র এবং কর্মহীনতার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে ইউরোপ৷ ফিনল্যান্ডের সরকার সেই তত্ত্বের আংশিক গ্রহণ করেছিল এবং কর্মহীন এবং বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার অর্থ অনেকটাই বৃদ্ধি করেছিল৷ ফলও মিলেছিল হাতেনাতে৷ দেখা গিয়েছিল, উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যবসায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই৷ যার ফলে পরিবারগুলির অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে৷ কেবলমাত্র সামাজিক সুরক্ষার অর্থের উপর তাদের আর নির্ভর করতে হচ্ছে না৷ ইউরোস্ট্যাট-এর সমীক্ষাতেও দেখা যাচ্ছে, ফিনল্যান্ড কর্মহীন এবং দারিদ্রসীমার সূচকে খুবই ভালো জায়গায় রয়েছে৷
ইউরোস্ট্যাট-এর রিপোর্ট জার্মানির বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে৷ ম্যার্কেলের অর্থনৈতিক ভাবনাকে অনেকেই তুলোধোনা করছেন৷ বামপন্থি নেত্রী কাটজা কিপিং বলেছেন, ইউরোস্ট্যাটের রিপোর্ট জার্মান সরকারের মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে৷
ইউরোস্ট্যাট-এর রিপোর্ট সাড়া ফেলেছে পূর্বের দুনিয়াতেও৷ সমীক্ষা রিপোর্টটি দেখে পূর্বের বহু অর্থনীতিবিদই বলছেন, পশ্চিমে এখনো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণাটি আছে৷ তারপরেও এত সংকট৷ পূর্বের দেশগুলিতে সামাজিক নিরাপত্তার ছিঁটেফোঁটাও নেই৷ অথচ কর্মহীনতা এবং দারিদ্র সেখানে আরো বড় সংকট৷ এ ধরনের রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে দরিদ্র মানুষ কী চরম সংকটে আছেন৷