1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অভিনেত্রীরা কেন এত আত্মহত্যাপ্রবণ?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

টলিউডের অভিনেত্রী পায়েল চক্রবর্তীর আত্মহত্যা একটা বিতর্ক উসকে দিলো৷ অভিনেত্রীদের আত্মহত্যার যে হিড়িক পড়েছে, তার জন্য দায়ী কি বদলে যেতে থাকা সমাজ, নাকি ব্যক্তিগত প্রত্যাশা পূরণের চাপ?

ছবি: picture-alliance/PYMCA/F. Finn

লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের গ্ল্যামার জগতে নিছক একজন বা দু'জনের আত্মহত্যার ঘটনা নয়, তালিকা বেশ দীর্ঘ৷ পায়েল চক্রবর্তীর আত্মহত্যার আগে গত তিন বছরের মধ্যেই মৌমিতা সাহা, বিতস্তা সাহা, দিশা গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মহত্যা সংবাদের শিরোনামে এসেছে৷ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও পাওয়া গিয়েছে এমন সংবাদ৷ মুম্বইয়ে প্রত্যুষা গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জলি শ্রীবাস্তব বা বিদিশা বেজবরুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা স্তম্ভিত করেছে দর্শকদের৷ সিনেজগতের এই মুখগুলি সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা নয়৷ এঁরা অভিনেত্রী৷ অভিনয়কে পেশা করার সুবাদে আমজনতা এঁদের রোজনামচায় আগ্রহ রাখেন৷ কিন্তু এঁদের সঙ্গে এমনকি ঘটে থাকতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথই বাছতে হয়েছে? শুধুই কি ব্যক্তিগত জীবনের চাপানউতোর, নাকি রূপোলি পর্দার অমোঘ আকর্ষণের পিছনে থাকা মানসিক অবসাদের গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছেন তাঁরা?

নিঃসন্দেহে মানুষের বিনোদনের বদল ঘটে গিয়েছে৷ বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বাঙালির জীবনযাত্রায়৷ চ্যানেলের সংখ্যার মতো বেড়েছে মেগা সিরিয়ালের সংখ্যাও৷ পেশাগত ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকের পাশাপাশি কাজের সুযোগও যে বেড়েছে সে ব্যাপারে শিল্পীরা একমত৷ ‘চেকমেট', ‘মা' ও ‘সাত পাঁকে বাঁধা'-সহ অনেক জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করা মানসী সিন্‌হা বললেন, ‘‘চ্যানেলও যেমন বেড়েছে, তেমনি কাজ অনেক বেড়েছে৷ মেগা সিরিয়ালের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজেও সুযোগ বেড়েছে৷ আর্টিস্ট ফোরামের সদস্যের সংখ্যা ২,৭০০৷ তার মানে শিল্পী-কলাকুশলীর সংখ্যা বেড়েছে৷ কাজের জোগান আছে বলেই আর্টিস্টের সংখ্যা বাড়ছে৷’’

জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসছে: অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

This browser does not support the audio element.

সত্যিই কি তাই? তাহলে ব্যান্ডেলের মৌমিতা সাহা সুইসাইড নোটে কেন লিখেছিলেন, ‘‘আমার আর অভিনেত্রী হওয়া হলো না?’’ সেটা কি কাজ না পাওয়ার আক্ষেপ, নাকি কাজের চাপ সামলাতে না পারার অবসাদ?

এর গভীরে ঢুকতেই চোখ রাখতে হবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে৷ সম্প্রতি বাংলা সিরিয়াল প্রচারে ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল বিনোদন চ্যানেলগুলি৷ বকেয়া পারিশ্রমিকের দাবিতে কেবল নয়, সিরিয়ালের কাজ বন্ধ ছিল অনেক কারণে৷ বাংলা সিরিয়ালের শিল্পী সংগঠন বা আর্টিস্ট ফোরামের অভিযোগ অনুযায়ী, এসব সিরিয়ালে গভীর রাত পর্যন্ত শ্যুটিং চলে৷ কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা বাঁধা থাকে না৷ এতে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের পারিবারিক জীবন বলে কিছু থাকে না৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমনটাই জানালেন আর্টিস্ট ফোরামের সম্পাদক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়৷ তাঁরা প্রযোজকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে কাজের সময়সীমা কমিয়ে এনেছেন৷ অরিন্দমের মতে, ‘‘এতে সুবিধা হয়েছে৷ রাত দশটার মধ্যে প্যাক-আপ হয়ে যাওয়াতে তাঁরা বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন৷ এতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসছে৷’’

পরিবার যে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করলেন মনোচিকিৎসক ডাঃ কামাল হোসেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এমনিতে গ্ল্যামার জগতের মানুষদের নার্সিসাস কমপ্লেক্স (নিজেকে বেশি ভালোবাসা) থাকে৷ এঁরা মনে মনে খুব নিঃসঙ্গও৷ তারপরে কাজের লাগামছাড়া চাপে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা কাছের মানুষের থেকে দূরত্ব কিন্তু একজনের কাছে খুবই হতাশাজনক হয়ে উঠতে পারে৷’’

অভিনয় পেশা শুধু টাকা দিচ্ছে না, দিচ্ছে সম্মান, খ্যাতি: লীনা গঙ্গোপাধ্যায়

This browser does not support the audio element.

দীর্ঘদিন টলিউডের সঙ্গে জড়িত টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অভিনেতা বাদশা মৈত্র এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন অল্প বয়সে অ্যাচিভ করাটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্রতিযোগিতার চাপটা সবাই একরকমভাবে সামলাতে পারে না৷ অথচ এই পেশার চাপ সামলানোটাই এখন কাজের অঙ্গ৷ এই চাপ সামলাতে না পারলে কখনো কখনো বেঁচে থাকাটাও খুব মুশকিল হয়ে যায় বৈকি৷’’       

কিন্তু কাজের চাপ যে কারও আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে, সেকথা মানতে নারাজ অভিনেত্রী সৌমিলী বিশ্বাস৷ তাঁর মতে, ‘‘কাজের চাপ যদি আত্মহত্যার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তো বড় বড় শিল্পীরা অনেক আগেই আত্মহত্যা করতেন৷ কাজের চাপ চিরকাল ছিল এবং থাকবে৷ সেটা তো সব জীবিকাতেই আছে৷’’

অসংখ্য মেগাসিরিয়ালের প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও একই সুরে বললেন, ‘‘অভিনয় পেশা শুধু টাকা দিচ্ছে না, দিচ্ছে সম্মান, খ্যাতি৷ তাই সে-সবের কথা মাথায় রেখে কাজের চাপটা নিচ্ছে সবাই৷’’ তাঁর দাবি, বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে আত্মহত্যা বেড়েছে৷ অভিনেত্রীদের পরপর এই আত্মহত্যা কোনোভাবেই টেলিভিশন পাড়ার কাজের চাপের সঙ্গে জড়িত নয়৷ তাঁদের মধ্যে এটা মিল শুধু যে তাঁরা অভিনয় করতেন৷ প্রযোজক হিসেবে বাংলা সিরিয়ালের শ্যুটিংয়ের সাম্প্রতিক সময়সীমা প্রসঙ্গে তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এমনিতে ১৪ ঘন্টা সময়টা শ্যুটিংয়ের জন্য যথেষ্ট৷ এখন রাত দশটা অব্দি শ্যুটিং হচ্ছে৷ অসুবিধা হচ্ছে না তো!’’   

গ্ল্যামার জগতের মানুষদের নার্সিসাস কমপ্লেক্স থাকে: ডাঃ কামাল হোসেন

This browser does not support the audio element.

মূল সমস্যার কারণ যে কেবল একটাই নয়, সে ইঙ্গিত মিলল অতীতের ‘হংসরাজ’খ্যাত অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাতেই৷ ৫২ বছর ধরে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে স্ট্রাগল করছেন, ইদানীংকার সিরিয়ালেও তাঁকে দেখা যাচ্ছে৷ তিনি স্পষ্ট করেই জানালেন, আজকাল প্রচারের আলো শিল্পীদের স্ট্রাগল করার উদ্যম কমিয়ে দিচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখনকার জেনারেশন স্ট্রাগল করতেই শিখছে না৷ একটা সিরিয়ালে অভিনয় করতেই নবাগতরা চ্যানেলের দৌলতে সারা শহরের হোর্ডিং জুড়ে নিজেদের ছবি দেখতে পাচ্ছে৷ রাতারাতি বিখ্যাতও হয়ে যাচ্ছে৷ এর ফলে অভিনয়ের অনুশীলন না করে, অর্থাৎ মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে তাঁরা পার্টি, নেশা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ ফলে অভিনয়ে ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে৷ তাই প্রথম কাজটাই অনেক ক্ষেত্রে শেষ কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ স্ট্রাগলিংয়ের জায়গাটা কমজোরি বলে সর্বনাশও ঘটছে৷’’

লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও সহমত এ ব্যপারে৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেকদিন অনেক ছেলেমেয়ে আসে, তারা অভিনয় করতে চায়৷ প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা, গ্রুমিং, প্রতিভা ছাড়াই তারা রূপোলি পর্দায় নামী হতে ইচ্ছুক৷ কাজেই চাহিদা বা জোগানের ভারসাম্য থাকবে না৷ নিজেকে তৈরি না করে শুধু রূপোলি জগতের হাতছানিতে এলে ডিপ্রেশন তো বাড়বেই৷’’

এখন অল্প বয়সে অ্যাচিভ করাটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে: বাদশা মৈত্র

This browser does not support the audio element.

সম্প্রতি মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকা কারিনা কাপুর খান বলেছেন, ‘‘অভিনয় শিল্পীদের রোল মডেল মানা হয়, তাই মানুষের জন্য সঠিক উদাহরণ হয়ে ওঠাটাই আমাদের দায়িত্ব৷’’ কিন্তু সেই ভূমিকা কি গ্রহণ করতে পারছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা? নাকি তাঁরা নিজেদের জীবন-সঙ্কটের আবর্তে বাঁধা পড়ে যাচ্ছেন? অভিনয় জগতের মানুষদের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকতেই পারে, তবে অভিনয় পেশা যে অন্যান্য পেশাগুলির তুলনায় বাড়তি চাপ বহন করে, সে কথা স্বীকার করেন সকলেই৷

প্রযুক্তি নির্ভরতার দরুণ অল্প আয়াসে খ্যাত হয়ে যাওয়াটাও আজকাল অভিনয় জগতে স্ট্রাগলিংয়ের জায়গাটা নড়বড় করে দিচ্ছে৷ উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়া বা রিয়েলিটি শো দিয়ে দিচ্ছে আকাশচুম্বী স্বপ্ন৷ যেটা সফল করতে না পারলেই নেমে আসে মানসিক অবসাদ এবং আত্মহননের ভাবনা৷ এসব ব্যাপারে পরিবার বা বাবা-মা-কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেন মনোচিকিৎসক ডঃ কামাল হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘শৈশব থেকে শিশুদের সেই পাঠটাই পড়ানো উচিত, যা জীবনে হার-জিতের আগে মানুষকে কাজের আনন্দ নিতে শেখাবে, জীবনে যতটা পেলাম ততটাই উপভোগ করতে শেখাবে৷ অভিনয়টা কাজের আনন্দেই করা উচিত, হোর্ডিংয়ের মুখ হওয়ার জন্য নয়৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ