কলকাতায় এ বছর পয়লা বৈশাখের দিন ঢাকার আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে৷ বাংলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির পাল্টা আন্দোলন হিসেবে৷
বিজ্ঞাপন
কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গে কট্টর দক্ষিণপন্থি, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির ক্রমশ উত্থান ঘটছে৷ এই ব্যাপারটা রাজ্যের রাজনৈতিক মহলও আর অস্বীকার করতে পারবে না৷ হাতের কাছেই উদাহরণ কাঁথি উপনির্বাচনের ফলাফল৷ সদ্য হওয়া এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী জয়ী হলেও প্রচুর ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছেন৷ এবং ভোট কমেছে বাম প্রার্থীর৷ এই প্রথম নয়, কাঁথিতে এর আগের তিনটি নির্বাচনেই দেখা যাচ্ছে ভোট কমছে বাম প্রার্থীদের, ভোট বাড়ছে বিজেপির৷ এই পরিস্থিতিতে যেখানে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং প্রখর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গে প্রচার এবং প্রভাব বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে, তেড়েফুঁড়ে উঠেছে রাজ্য বিজেপি, সম্প্রতি রাজ্যে তথাকথিত গো-বলয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি রামনবমী পালনের ধূম পড়েছে, রীতিমতো সন্ত্রস্ত বোধ করছেন পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ৷ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা তারা আরও এক ভুল পথ বলে মনে করছেন৷ বরং তাঁদের মনে হচ্ছে, বাঙালির নিজস্ব যে সংস্কৃতি, যা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন, তাই এবার পালন করতে হবে প্রকাশ্যে, ধর্মীয় রাজনীতির পাল্টা হিসেবে৷
ShamimAhmed - MP3-Stereo
সেই কারণে এবার খাস কলকাতা শহরে, ১৫ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখের দিন তিনটি মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে, যেমনটা হয় প্রতিবছর ঢাকায়৷ এই তিনটি শোভাযাত্রার মধ্যে একটি অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে ‘বাংলা ভাষা প্রসার ও চেতনা সমিতি'-র উদ্যোগে৷ কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের লাগোয়া রাজ্য চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় থেকে একটি শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখ সকালে যাবে রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গন পর্যন্ত৷ সেখানে মেলা বসবে৷ বাংলাদেশের অনুকরণে ব্যবস্থা থাকবে পান্তাভাত, নোনা ইলিশ আর শুঁটকি মাছের৷ বাংলা পত্র-পত্রিকা বিক্রি হবে৷ দিনভর হবে বাংলা কবিতা পাঠ, বাংলা গান৷ এদিন সকালের আরেকটি শোভাযাত্রা হবে যাদবপুরে, যার গন্তব্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়৷ বেশ কিছুদিন ধরেই বিজেপির ছাত্র সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ'-এর নজর পড়েছে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র বলে পরিচিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সম্প্রতি সেখানে বেশ কিছু উপলক্ষ্যে এবিভিপি-র কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বচসা, এমনকি হাতাহাতিও হয়েছে৷ তাই এবার যাদবপুরেও হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, কতকটা সেই ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা প্রসারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই৷ তৃতীয় আরেকটি শোভাযাত্রা হবে পয়লা বৈশাখের বিকেলে, কলেজ স্ট্রিটে, যার নামকরণ হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘পয়লা বৈশাখের জুলুস'৷ সম্ভবত এটা বোঝাতেই যে, বাঙালির প্রাণের উৎসবে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতার স্থান কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই৷
SrotaDutta - MP3-Stereo
অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক শামিম আহমেদ যোগ দেবেন কলেজ স্ট্রিটের এই জুলুসে৷ তিনি মনে করছেন, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের সার্বজনিক উৎসবের আরও বেশি করে প্রয়োজন আছে, যা ধর্ম নিরপেক্ষতার ভাবনাকে আরও মজবুত করবে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে যেমন সাজ-সজ্জায় তাতে ইসলামবিরোধিতার অভিযোগ ওঠে, তাকেও অবান্তর মনে করেন শামিম৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের মঙ্গলযাত্রার কোনো প্রচলন ছিল না, এবং বিষয়টা রাম-নবমীর মতোই নতুন বলে শামিম রসিকতা করলেন, কিন্তু তাঁর জোরদার ধারণা, এমন নতুন জিনিস, যা সকলের জন্যে ভালো, তার আরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার আছে৷
তবে পয়লা বৈশাখের উদযাপন একেবারে ছিল না, তাও নয়৷ বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, গবেষক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা স্রোতা দত্ত জানালেন, এখন যেমন শান্তিনিকেতনে ২৫ বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হয়, ২০ বছর আগেও তেমনটা হতো না৷ গরমের ছুটি পড়ার আগে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখেই শান্তিনিকেতনে ২৫ বৈশাখ পালিত হতো৷ সকালের বিশেষ প্রার্থনার পর আশ্রমের একটা বিশেষ জায়গায় জড়ো হতো সবাই৷ যেখানে নানা মনীষীর লেখা থেকে পাঠ করে শোনাত ছাত্র-ছাত্রীরা৷ বিদেশ থেকে আসা গবেষকরাও নানা বই থেকে পড়ে শোনাতেন৷ দিনের শেষ হতো রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি নৃত্যনাট্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে৷ রবীন্দ্রনাথের আমল থেকেই এমনটা হয়ে এসেছে৷ ধর্মের কোনো ছোঁয়াচ ছিল না সেই বর্ষবরণেও৷
ভারতীয় জাতিসত্তায় মিশে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মুখের ভাষা কে কাড়বে? ১৪২৪ বঙ্গাব্দের সূচনায় বাংলার আবেগ, ইতিহাস ও আধুনিকতায় অখণ্ড বাঙালিয়ানারই উদযাপন৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
লালখাতা হালখাতা
কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় লিখেছেন, ‘‘কেবল কলসি উচ্ছুগ্গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন৷’’ ব্যবসায়ী গদিতে বসলে এই লালখাতার অন্য মাহাত্ম্য৷ এতে লেখা থাকে লেনদেন, বাকি-বকেয়ার হিসেবনিকেশ৷পাটোয়ার বাগানে চলছে হালখাতার কেনাবেচা৷
ছবি: Payel Samanta
প্যাকেটজাত লৌকিকতা
অতীতের পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের বর্তমান রূপ হালখাতা৷ জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা নিয়ে তাঁদের মিষ্টি খাওয়াতেন৷ পরম্পরা মেনে এখন প্যাকেটে মোড়া হয় মুখমিষ্টির লৌকিকতা৷ মহাত্মা গান্ধী রোডের কাছে একটি মিষ্টির প্যাকেটের দোকান৷
ছবি: Payel Samanta
হোর্ডিংয়ের শুভেচ্ছায় জনসংযোগ
শহর ছেয়েছে এমন নানা হোর্ডিংয়ে৷ তাতে ১৪২৪ বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছাবার্তা৷ ঝালিয়ে নেওয়া জনসংযোগ, আর এক দফা প্রচারও৷ এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের সামনে৷
ছবি: Payel Samanta
সোনার হরিণ চাই
নতুন বছর কি ভাগ্যে বদল আনবে? মন্দ কপাল খোলে কিনা, পয়লা বৈশাখে তারই পরীক্ষা৷ নববর্ষ বাম্পার লটারির ঘোষণা চারপাশে৷ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের একটি দোকান৷
ছবি: Payel Samanta
পয়লা মানেই পঞ্জিকা
উনিশ শতকে কলকাতার বনেদি বাড়িতে বছর পয়লায় পঞ্জিকা পাঠ হতো৷ ১৮১৮ সালে প্রথম ছাপা পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়৷ ই-সংস্কৃতির যুগেও নতুন বছর এলে পত্রিকার স্টলে অতিথি পঞ্জিকা৷ শিয়ালদহ উড়ালপুলের নীচে একটি দোকানে৷
ছবি: Payel Samanta
মার্কেটিং কারে কয়
নববর্ষে অতীতের বটতলায় জন্ম হয়েছিল কলকাতার বাজারের, যা এখন শপিং মলে রূপান্তরিত৷ পণ্যসংস্কৃতি গিলে খেলেও নতুন বছরের আবাহনে মিলে গিয়েছে সেকাল-একাল৷ ধর্মতলার বিপণিতে পয়লা বৈশাখের অফার ঘোষণা৷
ছবি: Payel Samanta
চারচাকায় বিপণন
বাঙালির আনন্দ, ফুর্তি, খানাপিনাতেও বিপণনের হাতছানি৷ নতুন বছর তাই বহুজাতিক সংস্থারও পুঁজি৷ ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে শহরজুড়ে পণ্যের প্রচার৷ চিড়িয়া মোড়ের কাছে বাহারি গাড়ি৷
ছবি: Payel Samanta
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে
শুভ বৈশাখীতে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা অখণ্ড বাঙালি সত্তার বিজ্ঞাপন৷ মৌলবাদী হুঙ্কারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কলকাতাও শক্ত করেছে ঢাকার হাত৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার দিকে দিকে৷
ছবি: Payel Samanta
নাচো তো দেখি
হুতোম লিখেছেন, ‘‘কলকেতা সহরের আমোদ শিগগির ফুরায় না৷’’ অতীতে বাঙালির নববর্ষ ছিল চৈত্র সংক্রান্তি আর চড়ক উৎসবেরই বাড়তি একটি দিন৷ একুশ শতকের কলকাতাতেও দুই বছরের সন্ধিক্ষণে আমুদে নাচ হরগৌরীর৷ যশোর রোডের ধারে ফুটপাতে৷
ছবি: Payel Samanta
অতি বড় বৃদ্ধ পতি
বাঙালির বারোমাস্যায় একদিকে প্রাচুর্য, অন্যদিকে অনটন৷ ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত বৃদ্ধ শিবের কাহিনি নিয়ে বাঙালির যে চিরায়ত লোকাচার, এ শতকেও সেই পরম্পরা বহমান৷ নাগেরবাজারে মৎস বিক্রেতার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী গৌরী৷ সামনে বহুমূল্য ইলিশ নববর্ষের পাতে পড়ার অপেক্ষায়৷
ছবি: Payel Samanta
এসো বসো আহারে
বাঙালি নববর্ষে ‘খাই খাই’ করবে না, তা কী হয়! বিশ শতক থেকেই বাবুবাড়ির হেঁশেলে বিপুল আয়োজন থাকত পয়লা বৈশাখে৷ সরু চালের সুগন্ধী ভাত, ঘন মুগডাল, হরেক ভাজাভুজি, নানা অভিনব পদের প্রাচুর্য নিয়ে এ কালেও তৈরি কলকাতার হোটেল ও রেস্তোরাঁ৷ মধ্য কলকাতার একটি রেস্তোরাঁর নববর্ষের অন্দরসজ্জা৷
ছবি: Payel Samanta
বই নিয়ে হইচই
বিশ শতকে নববর্ষে বাবুরা বৈঠকখানায় মজলিস বসাতেন৷ খেমটা, কবিগান, টপ্পা, সঙ, যাত্রায় জমজমাট ছিল বর্ষবরণ৷ সময়ের সঙ্গে বদলেছে উদযাপনের ধরন৷ তাই বছরের শুরুতে এখন শিক্ষিত বাঙালির নয়া পার্বণ বই উৎসব৷ কলেজ স্কোয়ারে তারই বর্ণাঢ্য উদ্বোধন৷
ছবি: Payel Samanta
গৃহস্থের উৎসব
সেকালের নববর্ষে বাবু বাড়িতে মেহফিলের আসর মাতাতো সস্তা আতরের গন্ধ, বেলিফুলের মালা৷ বাঈজির গান আর কুলফি মালাইওয়ালাদের ডাক অলিগলি হয়ে রাজপথে মিশত রাতের দিকে৷ এখন ‘বাবু সংস্কৃতি’ অতীত, এ যুগেও গৃহস্থের কাছে নববর্ষ মানে কলাপাতা সাজিয়ে মঙ্গলঘট স্থাপন৷ দমদমের দশকর্মা ভাণ্ডারে তারই যাবতীয় উপকরণ মজুত৷
ছবি: Payel Samanta
পরানুকরণে বাঙালি
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সিদ্ধিদাতা গণেশের যোগ সেকালে ছিল না৷ পশ্চিম ভারতের গণেশ আরাধনা বাঙালিকে নববর্ষে গণেশ পুজো শিখিয়েছে৷ হালখাতার সঙ্গে সিদ্ধিদাতার অনিবার্য সহাবস্থান৷ প্রতিমার বিকিকিনি গড়িয়াহাটের কাছে৷
ছবি: Payel Samanta
নববর্ষ সংখ্যা
কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা নববর্ষে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর বিশেষ সংখ্যা বের করেছিলেন৷ সেই পরম্পরায় আজও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ নববর্ষ সংখ্যা৷
ছবি: Payel Samanta
মধুর তোমার শেষ যে না পাই
এককালে বাঙালির পাতে পড়ত ঘরে তৈরি মিষ্টির সম্ভার৷ সেই নারকেল নাড়ু, ছানার জিলিপি, সন্দেশ, মালপোয়া ঠেলে বাঙালি এখন অবাঙালি লাড্ডু-বরফি-শোনপাপড়ির প্রেমে মজেছে৷ উৎসব মুহূর্তে কালিন্দিতে মিষ্টির দোকানে ভিড়৷
ছবি: Payel Samanta
সম্প্রীতির নতুন বছর
ধর্মের নামে বাঙালির মধ্যে ভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সেরা বিজ্ঞাপন বাংলা নববর্ষ৷ হাবড়ার মকবুল শেখ নববর্ষে হিন্দু গৃহস্থের পুজোর উপকরণ ডাব, কলাপাতা নিয়ে বসেছেন৷ দমদম রোডের ধারে দিনভর দারুণ বিক্রি, হাসি ফুটেছে মকবুলের মুখে৷