কলকাতায় পুলিশ বলছে দূষণ কম, মানছেন না পরিবেশবিদরা
২১ অক্টোবর ২০২৫
প্রতিবছরের মতো এবছরও দীপাবলির আলোর উৎসবে নেমে এসেছে দূষণের অন্ধকার ছায়া। মঙ্গলবার সকালে দিল্লির গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ ছিল ৪৩৩। বেশ কিছু জায়গায় তা ৫০০-র উপরে। দিল্লির বায়ুদূষণ পরিস্থিতি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ংকর ক্ষতিকর জায়গায় চলে গেছে। পিছয়ে নেই কলকাতাও। মঙ্গলবার সকালে কলকাতায় বায়ুদূষণের পরিমাণ হলো ১৯৩, যা অস্বাস্থ্যকর। তবে হাওড়ার একাধিক অঞ্চলে ২০০-র উপরে উঠেছে বায়ুদূষণের পরিমাণ। বেলুড়ে রাত ১০টায় ৩৬৫ ছোঁয় দূষণের মাত্রা।
এক রাতের চিত্র
সুপ্রিম কোর্ট এবার দিল্লিতে গ্রিন বাজি পোড়াবার অনুমতি দিয়েছে। তার ফলে সমানে শব্দ ও আলোর বাজি ফেটে গেছে। রাত বারোটার সময়ও দিল্লিতে দেদার বাজি ফেটেছে। একই ছবি দিল্লির পাশের শহর গুরুগ্রামে। মঙ্গলবার সকালেও বাজি ফাটানো চলছে।
দিল্লিতে আবার একটা ধোঁয়াশার আস্তরণ দেখা দিয়েছে। দৃশ্যমানতা কমে গেছে। যারা শ্বাসকষ্টের রোগী তাদের কষ্ট বেড়েছে। এর সঙ্গে যদি খড় পোড়ানোর ধোঁয়া আসতে শুরু করে, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর জায়গায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পুলিশের দাবি
তবে কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভর্মার মতে, অন্যান্য বারের তুলনায় শহরে দূষণের মাত্রা কমেছে। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, "শব্দ ৯০ ডেসিবলের থেকে কম রয়েছে মানে তা সীমার মধ্যেই রয়েছে। এ সংক্রান্ত সীমা ১২৫ ডেসিবল। এ ছাড়া, আমরা সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বায়ুদূষণের উপরেও নজর রেখেছিলাম। তখনও পর্যন্ত সারা ভারতের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কলকাতায় দূষণ কম ছিল। রাত ১০টা কিংবা ১২টার রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে গোটা চিত্রটা স্পষ্ট হবে।" পুলিশ দাবি করেছে, বায়ুদূষণ বা শব্দদূষণ --- দুই ক্ষেত্রেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কলকাতায় কম ধরা পরেছে দূষণের মাত্রা।
বাস্তব চিত্র
তবে পরিবেশ কর্মীদের দাবি, আইন ও প্রশাসনকে একপ্রকার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাজি ফাটানো হয়েছে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায়। এই বছর সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন বাজি ফাটানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলো রাত আটটা থেকে ১০টা। এই মধ্যে কেবলমাত্র সবুজ বাজি-ই ফাটানোর অনুমতি ছিলো। বাস্তবে সন্ধ্যা নামার সময় থেকেই শুরু হয় দেদার বাজির প্রকোপ। শ্যামবাজার, সল্ট লেক, বেহালাসহ একাধিক অঞ্চলে বাজির দৌরাত্ম্য চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সবুজ বাজি প্রকৃত অর্থে অনুমোদিত কিনা সেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মীরা।
পরিবেশবিদ মল্লিকা জালান ডিডাব্লিউকে জানান, তার সল্ট লেকের বাড়ির পাশে রাত দুটো পর্যন্ত বাজি ফেটেছে। তিনি বলেন, "আমার সঙ্গে একজন ষাটোর্দ্ধ নারী এবং ১৮ বছর বয়সী এক যুবক ছিলেন। বাজির দাপটে দুই জনই কষ্ট পেয়েছেন। প্রায় কাছাকাছি ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর। দু'পা দূরে পুলিশ থানা। কোনো লাভ হয়নি।"
'দূষণ আটকানোর চেষ্টাই হয়নি'
একই স্বর পরিবেশকর্মী এবং সবুজ মঞ্চের আধিকারিক নব দত্তর গলায়। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "বিগত ১৫ বছর ধরে আমি কালীপুজোর রাতে সারা শহর ঘুরি। গত বছরের থেকে এই বছরের অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তার মতে, পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডসহ যে যে কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষন করে দূষণ আটনাকোর কথা ছিল, তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার বাজি বানাতে দিয়েছে, মজুত করতে দিয়েছে, এমনকী, বাজারে বিক্রিও করতে দিয়েছে। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই বছর নির্দিষ্ট বাজি বাজার ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় দেদার বিক্রি হয়েছে বাজি। তার বেশিরভাগই সবুজ বাজি অনুমোদন প্রাপ্ত নয়।"
নবর মতে, সাধারণ নাগরিক আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। তিনি বলেন, 'আমরা শিশুমঙ্গল হাসপাতাল, আরজি কর সংলগ্ন হাসপাতালে বাজি ফাটাতে দেখেছি। মাত্র গুটি কয়েক দুর্বৃত্ত এটা করেছে। বেশির ভাগ মানুষ বিব্রত হচ্ছেন, কষ্ট পাচ্ছেন। শব্দ মাত্রার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। ১২ ডেসিবেলের মাত্রা বহুগুণ ছাড়িয়ে কলকাতায় ন্যূনতম ২৫০ থেকে ৩০০ ডেসিবেলের বাজি ফেটেছে।"
'কে পরীক্ষা করবে সবুজ বাজি কিনা'
আদালতের নির্দেশ অনুসারে, কেবলমাত্র সবুজ বাজি, যা অন্যান্য বাজির তুলনায় ৩০০ শতাংশ কম ক্ষতিকারক, তৈরি এবং বিক্রি করা যায়। এর আগে সবুজ বাজিতে মিলত একটি কিউআর কোড। এর থেকে বাজি সম্পর্কে নানান তথ্য পাওয়া যেত। এই বছর সেই কোড ছাড়াও প্রচুর বাজি বিক্রি হয়েছে। বাজি প্রস্তুতকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কিউআর কোডে সমস্যা থাকায় তারা অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করেননি।
নব বলেন, "কোনো নির্দেশিকা, আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই বাজি নির্মাতারা কিউআরকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। কী করে সেটা সম্ভব হলো তার কোনো উত্তর নেই। অন্যান্য বারের তুলনায় বাজি বিক্রি বহুগুণ বেড়ে গেল। সোমবার কালীপুজোর দিন পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সবুজ বাজি ব্যবহার করতে বললেন। অথচ কোন বাজি এর আওতায় পড়ে আর কোনটা পড়ে না, তা কেউ জানে না। আর সবুজ বাজি ছাড়া অন্য বাজি যে ব্যাপক ভাবে বিক্রি করা হলো তা আটকানো গেলো না। স্পষ্টতই, সরকার একদন দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দিলো। আর সাধারণ মানুষ, যারা প্রকৃত অর্থে বাজি থেকে দূরে থাকেন, তারা কষ্ট পেলেন।"
প্রতিবছরের মতো সারা দেশেই কালী পুজো এবং দেওয়ালি ঘিরে চলে দূষণ এবং তার প্রতিকার সংক্রান্ত আলোচনা। তাতে পরিবর্তন আসে সামান্যই। কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে মল্লিকা বলেন, সরকারের হস্থক্ষেপ এবং সাধারণ মানুষের সদিচ্ছা থাকলেই একমাত্র এই দূষণ আটকানো সম্ভব। তিনি বলেন, "এই সময়ে দূষণের মাত্রা বাড়ার একাধিক কারণ আছে। বর্ষাকাল শেষ হয়ে আর্দ্রতা কমে যায়। দেশে নানা অঞ্চলে খড় পোরানো হয়। তার উপরে বাজি দূষণের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সবুজ বাজি নয়, সরকারকে সব বাজি নিষিদ্ধ করতে হবে। দূষণ রুখতে সবুজ বাজি কোনো সমাধান হতেই পারে না। দীপাবলি আলোর উৎসব। সেখানে বাজির ভূমিকাকে বাদ দিতেই হবে।"