শিক্ষকের ঘরে ঢুকে নিগ্রহ করা হলো কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন সায়েন্স কলেজে৷ অভিযুক্ত ছাত্র শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা৷ ইতিমধ্যেই ঘটনাটি নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
আগেও ছিল৷ তবে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর দিকে দিকে শিক্ষকনিগ্রহের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ সর্বশেষ ঘটনা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে৷ গত ৬ ফেব্রুয়ারি শতাব্দীপ্রাচীন সায়েন্স কলেজে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ভাস্কর দাসের ওপর গৌরব দত্ত নামে এক তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা চড়াও হয় বলে অভিযোগ৷ শিক্ষকের ঘরে ঢুকে অভিযুক্ত ছাত্র চড় থাপ্পর মারে বলে অভিযোগ৷ ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে ঘটনার নিন্দা এবং প্রতিবাদ করা হয়৷ অবিলম্বে ওই ছাত্রকে গ্রেফতার করার দাবিও ওঠে৷ যদিও পুলিশ ওই ছাত্রকে গ্রেফতার করেনি৷ পরে আদালতে আত্মসমর্পন করে ওই ছাত্র জামিন পেয়ে যান৷
স্বাভাবিকভাবেই ঘটনার প্রতিবাদ করে বিরোধীদল সিপিএম৷ সিপিএমের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী ভাস্কর দাসের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন৷ ঘটনার প্রতিবাদে সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে একটি সভাও করার কথা৷ সেখানে ভাস্কর দাসকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷
এদিকে ঘটনার নিন্দা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও৷ যদিও তাঁর বক্তব্য, ‘‘শিক্ষকেরা গুরুজন৷ তাঁদের উপর চড়াও হওয়া সবসময়ই অন্যায়৷ কিন্তু শিক্ষকেরই বা রাজনৈতিক রং থাকবে কেন?'' সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে ভাস্করবাবুর জড়িত থাকার বিষয়টিকেই চিহ্নিত করেছেন তিনি৷ তা শুনে রাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বটেই তো! শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মাঝে কখনোই রাজনীতির রং থাকা উচিত নয়৷ কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তির মুখে কি এ কথা সাজে?
দুর্লভ ছবিতে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস
বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
এদেশের ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা৷ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করায় তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
তৎকালীন ছাত্রনেতারা
নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন এবং ওই সময়ের অন্যসব জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করতেন৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷
ছবি: Journey/R. Hoque
বঙ্গবন্ধু পথপ্রদর্শক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে কোনো রাজনীতিবিদ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক৷ বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Journey/M. Alam
ছয়দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়৷ মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের এ প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন৷
ছবি: Journey/R. Talukder
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়৷ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ পরদিন তারা পল্টন ময়দানে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়৷ শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷
ছবি: Journey/R. Talukder
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷ উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার যথার্থভাবেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয়তাবাদী অভিধাগুলি, যেমন দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷
ছবি: Journey
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো৷ গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়৷
ছবি: Journey/M. Alam
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দিয়েছে৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন হয়৷ শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা৷
ছবি: Journey/Y. Saad
২০০২ শামসুন্নাহার হল আন্দোলন
২০০২ সালের ২২ জুলাই রাত ১টায় অর্থাৎ ২৩শে জুলাই দিবাগত রাতে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর রাতের অন্ধকারে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ২৩ শে জুলাই সকাল থেকে ছাত্রদল ব্যতীত ক্যাম্পাসের ক্রীয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ ১ লা আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন ভিসি৷
ছবি: Journey/Z. Islam
২০০৭ সালে ছাত্র আন্দোলন
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক হন আট শিক্ষক, এক কর্মকর্তা৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের মুক্তি
দু’দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত কয়েকশ জন আহত হয়৷ পরে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে দণ্ড পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে ডিসেম্বরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার৷ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ছেড়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
13 ছবি1 | 13
বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্র রাজনীতিমুক্ত তো হয়ইনি, বরং তার প্রকোপ আরো বেড়েছে৷ অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার সময় বলেছিলেন, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করা হবে৷ সিপিএমের সময় নিয়োগ থেকে ছাত্র সংসদ সর্বত্র যে শাসকদলের ছায়া পড়েছিল,তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কিছুই ঘটেনি৷ বরং উল্টোটাই ঘটেছে৷ নিন্দকেরা বলছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন, কেন শিক্ষকের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক থাকবে, তখন তিনি ভুলে যান, শিক্ষকদের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হন তৃণমূলনেত্রী৷ শুধু তাই নয়, মঞ্চে হাজির থাকেন একাধিক তৃণমূলের নেতা৷ অর্থাৎ, শিক্ষকদের শাসকদলের অনুগত করার চেষ্টা জারি আছে৷ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গাত্রদাহ হচ্ছে, কারণ, আক্রান্ত শিক্ষক শাসকদলের সংগঠন করেন না৷ সে কারণেই সম্ভবত রাজনীতির প্রসঙ্গ তিনি তুলছেন৷
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করার দাবি তুলেছেন একাধিক শিক্ষাবিদ৷ সাম্প্রতিক ঘটনার পর আবারো সরব হয়েছেন তাঁরা৷