কলকাতার আরেকটি বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়লো। এন্টালিতে একটি পরিত্যক্ত কারখানার ছাদ ভেঙে মারা গেলেন দুইজন।
বিজ্ঞাপন
রোববার রাতে এই ঘটনা ঘটেছে এন্টালির কনভেন্ট রোডে। হঠাতই প্রচণ্ড শব্দ করে কনভেন্ট রোডে একটি পরিত্যক্ত কারখানার ছাদের একাংশ ধসে পড়লে মুজিবুর রহমান (৩৪) এবং শাহিদুর রহমান (৪২) নামের দুই ব্যক্তি প্রাণ হারান। নিহতরা দুই ভাই৷ ওই বাড়ির রক্ষী ছিলেন তারা৷
স্থানীয় মানুষ ও পুলিশ এসে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই ভাইকে উদ্ধার করেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম পরে ঘটনাস্থলে যান। তিনি বলেন, ''বাড়িটিতে আগে রাসায়নিকের কারখানা ছিল। বছর তিরিশ হলো কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।''
মেয়র আরো বলেন, ''কলকাতা পুরসভা আগেই বাড়িটি বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করেছিল।'' সোমবার (আজ) বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি৷
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র নেতা, পুর প্রতিনিধি সজল ঘোষ বাড়ি ধসে পড়ে দুই ভাইয়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘একের পর এক বাড়ি ভেঙে পড়ছে। পুরসভা কিছুই করছে না।''
জরাজীর্ণ বাড়ি
ডিডাব্লিউর চিত্রসাংবাদিক সত্যজিৎ সাউ সোমবার এন্টালির ধসে পড়া বাড়িটিতে যান৷ সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি জানান ''বাড়িটি প্রায় একশ বছরের পুরনো। কিন্তু যেহেতু বহুদিন ধরে অযত্নে পড়েছিল, তাই বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় বড় গাছ গজিয়ে গেছে।''
তিনি আরো জানান, ''কলকাতা পুরসভা অন্তত সোমবার দুপুর পর্যন্ত বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করেনি। তবে বাড়ির বাইরে বিপজ্জনক বাড়ির বোর্ড লাগানো আছে। পুলিশ এখন কাউকে বাড়ির ভিতরে যেতে দিচ্ছে না।''
কলকাতার বিপজ্জনক বাড়ি
কলকাতা-জুড়ে এরকম বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। প্রতিবার বর্ষায় বা অন্য সময়ে কয়েকটি বাড়ি ভেঙে পড়ে।
পুরসভা কর্তৃপক্ষ অনেকবার বলেছে সব বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে দেবে। অনেক বাড়িতেই মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাস করেন। কিন্তু তারপরেও সেসব বাড়ি ভাঙা হয়নি।
পুরসভার সূত্র ডিডাব্লিউকে জানায়, ''পুরসভার একটা উদাসীনতা আছে এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু সেটাই সব নয়। পুর আইনে বলা হয়েছে, মালিকরা বাড়ি ভাঙলে নিয়মে কিছুটা ছাড় পাবেন। তারা বেশি জায়গা জুড়েও বাড়ি বানাতে পারবেন। কিন্তু তাতে দমকলের আপত্তি আছে।''
সূত্র জানাচ্ছে, ''সেই সঙ্গে আইনি ঝামেলা রয়েছে। ভাড়াটে-মালিক ঝগড়া হলে তারা আইনি ব্যবস্থা নেন। আর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে। ফলে সেই সব বাড়ির কিছু করা সম্ভব নয়। মালিক ও ভাড়াটেরাও এই বিষয়ে কতা শুনতে রাজি হন না।''
সূত্র জানিয়েছে, ''তার উপর আরেকটি সমস্যা আছে। পুরনো, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন করে তুলতে গেলেই রাজনৈতিক দাদারা এসে হাজির হন। তাদের দাবি-দাওয়া মেটানোর ক্ষমতা অনেকের থাকে না বা তারা ভয় পান, পরে সেই দাবির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।''
ফলে সবমিলিয়ে সমস্যার মূল অনেক গভীরে চলে গেছে।
বিপজ্জনক বাড়িতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস
কলকাতাজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বিপজ্জনক বাড়ি। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। কী করছে পুরসভা?
ছবি: Subrata Goswami/DW
পদে পদে বিপদ
প্রতি পদে বিপদ আর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন মানুষ। কোথাও রাস্তার উপরে ঝুলছে পুরনো, বিপজ্জনক বাড়ির ভাঙা বারান্দা, কোথাও পুরনো বাড়ির গায়ে লাগানো লোহার শিক বেরিয়ে আছে। যে কোনও মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। আবার বহু জায়গায় বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভেঙেও পড়েছে। বাড়ির যেটুকু অংশ এখনও দাঁড়িয়ে, তা থেকে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দুইহাজারের বেশি বিপজ্জনক বাড়ি
তিনশ বছরের শহর কলকাতায় পুরনো বাড়ির সংখ্যা অনেক। পুরসভার হিসাবে তা প্রায় দু’হাজার। সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু 'বিপজ্জনক' এবং 'অতিবিপজ্জনক' বাড়ি রয়েছে। বর্ষাকাল চলছে, যেকোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে বাড়িগুলি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চিন্তিত পুরসভা
প্রবল বৃষ্টিতে শুধুমাত্র জমা জলের সমস্যাই নয়, কলকাতা পুরসভার উদ্বেগের একটি বড় কারণ উত্তর কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা এই জরাজীর্ণ এবং বিপজ্জনক বাড়িগুলি। এই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ ধরা পড়েছে মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কণ্ঠে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
২১ নম্বর ওয়ার্ড
কলকাতা পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুরলেই চোখে পড়বে এমন নানা বিপদের ছবি। এলাকার পুরপ্রতিনিধি মীরা হাজরা জানালেন, শুধুমাত্র তার ওয়ার্ডেই রয়েছে অন্তত ১০৮টি পুরনো, বিপজ্জনক বাড়ি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মৃত্যু ফাঁদ
গতবছর বর্ষায় ভেঙে যায় এই বাড়িটির একাংশ। মারা যান এক দম্পতি। এখন আর কেউ এই বাড়িতে বসবাস করেন না। প্রাণভয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বাড়ি থেকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অস্থায়ী আস্তানা
স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় বাড়ির একটি ফাঁকা অংশে বেড়া দিয়ে অস্থায়ী আস্তানা করে দেওয়া হয়েছিল। এখনও তারা সেখানেই আছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পুরসভার নোটিস
পুরসভার বক্তব্য, প্রবল বৃষ্টিতে যে কোনও সময় পুরনো এবং বিপজ্জনক বাড়িগুলি ভেঙে পড়তে পারে। সব জায়গায় নোটিস দেওয়া সত্বেও কেউ বাড়ি খালি করতে চাইছেন না। বাড়ি ছাড়ার সঙ্গেসঙ্গেই ইভ্যাকুয়েশন সার্টিফিকেট কলকাতা পুরসভা দিয়ে দেবে। তাতেও তারা বিপজ্জনক বাড়ি ছাড়তে নারাজ বলে জানানো হচ্ছে পুরসভার পক্ষ থেকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সম্পত্তির প্রশ্ন
বিপদ মাথায় নিয়েই বছরের পর বছর ধরে জীর্ণ, বিপজ্জনক বাড়িতে বসবাস করে যাচ্ছেন বহু মানুষ। তাদের আশঙ্কা, “আজ যদি আমরা বাড়ি খালি করে দিই, তাহলে পরে আর তার অধিকার পাবো না।’’
ছবি: Subrata Goswami/DW
মালিক নেই
বহু ক্ষেত্রেই পুরনো তথা জরাজীর্ণ বাড়িগুলির মালিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সে প্রসঙ্গে মেয়রের বক্তব্য, ‘‘অনেক জায়গায় মালিক রয়েছেন। আবার এমন অনেক পুরনো বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বাড়ির মালিকের সংখ্যা একাধিক। তবে যে সব বাড়ি ভেঙে পড়ছে, সেই সব বাড়ি আমরা ভেঙে দেব। প্রয়োজনে সেই জমিতেই আমরা ঘর বানিয়ে দেব, যাতে সেখানে তারা থাকতে পারেন।’’
ছবি: Subrata Goswami/DW
শরিকি সমস্যা
একই বাড়ির অনেকগুলি শরিক থাকার কারণেও বাড়িগুলি ভগ্ন অবস্থায় দিনের পর দিন থেকে যাচ্ছে। একাধিক শরিক এবং একই বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে থাকা প্রচুর ভাড়াটে। নির্মাণসংস্থা এতগুলি মানুষকে পুনর্বাসন দিয়ে লাভের অঙ্ক ঘরে তুলতে পারবে না বলে পিছিয়ে যাচ্ছে, এমন যুক্তিও শোনা গেল কয়েকটি বাড়ির শরিকদের থেকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তৎপরতা কই?
কয়েকমাস আগেই কলকাতা পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে বিপজ্জনক বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ে। এর পরেই ওই ওয়ার্ডে ১০৮টি বিপজ্জনক বাড়ি চিহ্নিত হয়। তবে সেগুলি নিয়ে এখনও কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে খবর নেই। যদিও গার্ডেনরিচ ও দমদমের ঘটনার পরে যেখানে পুর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে কেন আগেই বিপজ্জনক বাড়ি নিয়ে তৎপর হল না পুরসভা, সেই প্রশ্ন উঠেছে।