কলকাতায় মেয়েরা কতটা নিরাপদ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০সম্প্রতি কলকাতার একটি ঘটনা ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে৷ শহরের দম্পতি নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় ও দীপ শতপথী মাঝরাতে এক তরুণীকে লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা করেছেন৷ নীলাঞ্জনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে তরুণীকে বাঁচিয়েছেন৷ তাঁর পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা৷
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতায় নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল দুই হাজার ১৭৬, যা ২০১৭ সালে ছিল এক হাজার ৯৭৫৷ তার আগের বছর অপরাধের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৬৯৩৷ অর্থাৎ, এই তিন বছরে অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে৷
নারী অধিকার কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ মনে করেন, এই হিসেব যেহেতু শুধু দায়ের হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে, তাই প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি৷ তিনি শ্রেণি অবস্থানের প্রসঙ্গও তুলেছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মধ্যরাতে শুধু নয়, সন্ধ্যাতেও মহিলারা নিরাপদ নন৷ আর গরিব পরিবারের মেয়েরা লাঞ্চিত হলে সেটা আড়ালে থেকে যায়৷ সাম্প্রতিক ঘটনায় দম্পতির শ্রেণি অবস্থান অনেক উঁচুতে, তাঁরা সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি এত গুরুত্ব পেয়েছে৷’’ পুলিশের আরো বেশি সক্রিয়তা ও নিরপেক্ষ ভূমিকার দাবি তুলেছেন তিনি৷
শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়াতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে কলকাতা পুলিশ৷ ‘তেজস্বিনী’ নামে একটি কর্মশালা শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের নভেম্বরে৷ এই কর্মশালায় ১২-৪০ বছর বয়সি মহিলাদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ কলকাতা পুলিশের নিজস্ব প্রশিক্ষকরা এখানে প্রশিক্ষণ দেন৷ এছাড়া রয়েছে বিশেষ মহিলা বাহিনী ‘উইনার্স’, যাদের কাজ ইভটিজিং রোখা৷ রয়েছে মহিলাদের আরও শক্তিশালী দল ‘ওয়ারিয়র্স’৷ এই দলের সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্রও চালাতে পারেন৷ ‘শক্তি’ নামে বেশ কয়েকটি ভ্যান শহরে টহল দেয়৷ তাদের দায়িত্বও নারীর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখা৷ এত কিছুর পরও কেন শহরে অপরাধ বাড়ছে?
প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের সাত দফা নির্দেশিকা কার্যকর করতেই হবে৷ নইলে অপরাধ কমবে না৷ এদেশে ক্ষমতাবানদের ধারণা, তারা অপরাধ করে টাকার জোরে পার পেয়ে যাবে৷ পুলিশও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না৷ এই দুয়ের যোগফলে সুবিচার পায় না আক্রান্ত৷’’
প্রয়াত সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘দহন’ উপন্যাসে এক নারীর লাঞ্ছনা ও তা নিয়ে আর এক নারীর প্রতিবাদের কথা বলা হয়েছে৷ নীলাঞ্জনারা তাঁরই উত্তরসূরি৷ ফ্যাশন ডিজাইনার ও বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা, তাই এটা আরো লজ্জার বিষয়৷ পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷’’ তবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ কমেছে৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ৩৯৪৷ তার আগের বছরে সংখ্যা ৩০ হাজার ৯৯২৷ ২০১৬ সালে অপরাধ হয়েছিল অনেক বেশি, ৩২ হাজার ৫০০৷ অর্থাৎ, রাজ্যজুড়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা কমলেও কলকাতায় বাড়ছে৷
যদিও এই পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়৷ তিনি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো তুলে ধরেন৷ কলকাতায় বেশি অপরাধের প্রসঙ্গে সুনন্দার বক্তব্য, ‘‘শহরে মেয়েরা সন্ধ্যার পর যতটা বাইরে থাকেন, গ্রাম-গঞ্জে থাকেন না৷ তাই তাঁরা কম আক্রান্ত হন৷ তাছাড়া শহরাঞ্চলে মহিলারা কর্মক্ষেত্রে ক্রমশ পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছেন৷ তাই ঈর্ষা-বিদ্বেষেও মেয়েদের জিঘাংসার শিকার হতে হচ্ছে৷’’