সরকারি দাবি ঠিক নয়৷ কলকাতা শহরের দূষণ হার বিপজ্জনকের থেকেও বেশি বিপজ্জনক৷ বলছেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
কলকাতার দূষণ পরিস্থিতি, যতটা জানা যায়, তার থেকে অনেক বেশি খারাপ৷ খারাপ, খুব খারাপ, বিপজ্জনকের সীমারেখা পেরিয়ে এই শহরের দূষণ এখন সহ্যসীমার অনেক ওপরে৷ ব্যস্ত এলাকাগুলোতে তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকের মতো গাছে ভরা জায়গাতেও দূষণের মাত্রা কখনও কখনও অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়৷ কাজেই কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা করা এখন কার্যত প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরার শামিল৷ বলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা৷ বাতাসে অস্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে মারাত্মক দূষণকণা, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে গিয়ে জমে যায়, রক্তে মিশে যায়৷ কাজেই কলকাতার মেয়র যদি বলে থাকেন যে, এই শহরের পরিবেশ বিশ্বের অনেক শহরের থেকেই ভালো, আদৌ বিপজ্জনক নয়, তা হলে তার থেকে বেশি সত্যের অপলাপ আর হয় না৷ মেয়রের উচিত, বিরোধিতায় না গিয়ে সচেতন হওয়া, সতর্ক হওয়া, দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া৷ পরিষ্কারই বললেন বিশিষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ৷
কলকাতায় দূষণ বাড়ার কারণ জানালেন সোমেন্দ্র ঘোষ
সম্প্রতি কলকাতার মার্কিন কনসুলেটে বসানো দূষণ পরিমাপের একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র সম্প্রতি জানায়, শহরের অভিজাত পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে দূষণের পরিমাণ স্বাভাবিক সহ্যসীমার অনেক ওপরে এবং কলকাতা বিশ্বের সবথেকে দূষিত শহর বললেও অত্যুক্তি হবে না৷ এই খবরের দু'দিনের মাথায় কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জি রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে দাবি করলেন, মার্কিন কনসুলেটের দাবি মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ ভুল পরিমাপ করেছে তাদের দূষণ নির্ণায়ক যন্ত্র এবং জেনেশুনে সেই ভুল তথ্য প্রকাশ করে কলকাতার মর্যাদা হানি করা হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে শহরের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, মার্কিন কনসুলেটের ওই যন্ত্রের মাপ যে ভুল, সেটা পুরসভা কী করে জানল! কনসুলেটে বসানো আছে অত্যাধুনিক ডিজিটাল পরিমাপ যন্ত্র, যার ভুল করার সম্ভাবনা প্রায় নেই৷ সেখানে কলকাতার দুটিমাত্র স্বয়ংক্রিয় এবং বাকি ৯টি ম্যানুয়াল দূষণ পরিমাপ ব্যবস্থা আছে, যা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অকজো হয়ে আছে৷ সেগুলি নাকি ক্যালিব্রেট করা হচ্ছে নতুন করে, যা এক বছরেও শেষ হলো না৷
এলইডি প্রযুক্তি বাড়াচ্ছে আলো-দূষণ
এলইডি আলো ব্যবহার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী৷ তবে এ প্রযুক্তিতে নীল ও শীতল রং তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহার করা হয় বলে আকাশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে৷ প্রযুক্তির ভাষায় এর মানে, বাড়ছে আলো-দূষণ৷
ছবি: picture alliance/F. Pritz/picturedesk.com
নগরীতে বিরল স্ফটিকস্বচ্ছ আকাশ
যেখানে মানুষ, সেখানেই কৃত্রিম আলো৷ বসতি থেকে দূরে কোথাও না গিয়ে এখন আর কৃত্রিম আলোমুক্ত স্বচ্ছ আকাশ দেখা সম্ভব নয়৷ মানুষ যত বেশি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করছে, ততই অনু্জ্জ্বল হয়ে উঠছে তারার আলো, ধীরে ধীরে যা একসময় চলে যেতে পারে একেবারে দৃষ্টির আড়ালে৷
ছবি: Imago/Westend61
বেশি উজ্জ্বল, বেশি সস্তা এলইডি লাইট
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ায় সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি মানুষ ব্যবহার করছে এলইডি লাইট৷ এ প্রযুক্তির শীতল নীল তরঙ্গ চারপাশের জ্বলজ্বলে আলো বেশি আকর্ষণ করে, যার ফলে বাড়ছে আলো-দূষণ৷
ছবি: picture alliance/dpa/L. Xiaoyang
সংরক্ষিত এলাকায় বন্ধ থাকে আলো
চিলির সংরক্ষিত এলাকা ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরিতে বাসার বাইরে কৃত্রিম আলো জ্বালানো নিষিদ্ধ৷ যদিও সংরক্ষিত এলাকা লোকালয় থেকে বেশ দূরে, তবুও আশেপাশের লোকালয়ে এ আলোর স্বল্পতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এলইডির বদলে জ্বালানো হয় উষ্ণ হলুদ আলো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schulz-Rohr
ক্রমবর্ধমান এলইডি
ভিজিবল ইনফ্রারেড ইমেজিং রেডিওমিটার (ভিআইআইআরএস) যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যায়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে কৃত্রিম আলোর তীব্রতা বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ৷
ছবি: NASA
অর্থনীতির সাথে আলোর সম্পর্ক
কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের সাথে সেদেশের কৃত্রিম আলো বাড়ার যোগাযোগ রয়েছে৷ উৎপাদন ও কৃত্রিম আলো বৃদ্ধি উদীয়মান অর্থনীতির অন্যতম লক্ষণ৷
ছবি: NASA/GSFC/Craig Mayhew & Robert Simmon
শরীর ঘড়ির রদবদল
কৃত্রিম আলো বদলে দিয়েছে প্রাণীজগতের জীবনধারা৷ ঘুমানোর সময় থেকে শুরু করে অন্যান্য জৈবিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয় কৃত্রিম আলোর কারণে৷ অনেক গাছের ক্ষেত্রে এর বৃদ্ধিও পরিবর্তিত হয় কৃত্রিম আলোর প্রভাবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Stratenschulte
স্মার্ট আলো
প্রশ্ন হলো, সারারাত রাস্তায় আলো জ্বালিয়ে রাখা কতটা যুক্তিসংগত? নড়াচড়া টের পেলেই আলো জ্বলবে, অন্য সময় আলোহীন বা কম আলো জ্বলে থাকবে, এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে রাতভর উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বন্ধ করে স্মার্ট আলোর ব্যবস্থা করা সম্ভব৷
ছবি: DW/L. Hansen
7 ছবি1 | 7
এছাড়া এই শহরের দূষণ পর্যবেক্ষকরা ২০১৩ সাল থেকেই নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলের দূষণহার পরিমাপ করে যাচ্ছেন এবং তার যা রিপোর্ট, তা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক৷ জানালেন বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বোঝালেন, কেন কলকাতায় দূষণ ক্রমশই বাড়ছে৷ প্রথমত, সারা শহর জুড়ে ফ্লাই ওভার এবং মেট্রো রেলের পথ নির্মাণের কাজ চলছে, যার দরুণ দূষণ বাড়ছে৷ দ্বিতীয়ত, আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ডিজেল চালিত ট্রাক অবাধে যাতায়াত করছে শহরের রাস্তায়৷ এবং প্রায় সব বড় মাপের বাণিজ্যিক যান ডিজেলে চলে৷ দিল্লির মতো সিএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের জ্বালানিতে চলা যান এই শহরে চালু করা যায়নি৷ এর পাশাপাশি আছে কয়লার উনুন, জঞ্জাল পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষতিকর অভ্যাস, যা শীতকালে পরিমণ্ডলে আটকে যায়৷ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে এলে, হাওয়ার গতি কমে গেলেই এই দূষণ জমির ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার মধ্যে আটকে পড়ে, যা প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস বিপজ্জনক করে তোলে৷
সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ জানাচ্ছেন, আজকাল অনেক মোবাইল অ্যাপ দিয়েও দূষণের হার জানা যায়৷ ঠিক যেভাবে এখন নিখুঁত জানা যায় আবহাওয়ার খবর৷ কাজেই কোনও তর্কবিতর্কে না গিয়ে নাগরিকেরা নিজেরাই এখন জানতে পারেন ঠিক কতটা খারাপ পরিবেশের মধ্যে তাঁরা আছেন৷ তাঁরাই বাধ্য করতে পারেন প্রশাসনকে, দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য৷
গতবছরের জুন মাসের ছবিঘরটি দেখুন...
বহুমাত্রিক দূষণের কবলে কলকাতা
‘রক্তে বিষ মিশে আছে প্রিয়তমা’— কবিতার লাইন সত্যি হয়েছে৷ দিল্লি বা বেঙ্গালুরুর তুলনায় দূষণ অনেকটাই কম কলকাতায়৷ তবুও আজ বহুমাত্রিক দূষণের কবলে মিছিলনগরী৷
ছবি: DW/Payel Samanta
সভ্যতার বিষবাষ্প
নিঃশ্বাসের সঙ্গে রোজ নানা ধরণের বিষাক্ত উপাদান গ্রহণ করেন কলকাতার মানুষ৷ বাতাসে নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেশি৷ শহর ও শহরতলির কারখানা ও গাড়ির ধোঁয়া বাড়াচ্ছে হাঁপানি ও ফুসফুসের অসুখ৷গত ৫ জুন ছিল আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস৷ এই দিনে কলকাতা কি কিছু শিখল?
ছবি: DW/Payel Samanta
জলে যখন মারণ রোগ
কলকাতার দূষণের নেপথ্যে অপরিকল্পিত শহর হিসেবে তার গড়ে ওঠা৷ লিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং, ক্রোম-লেদার প্রসেসিং এবং ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট ডাম্পিংয়ের বর্জ্যে দূষিত খাল-বিল৷ জলাশয় বুজিয়ে চলছে নগরায়ন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
বিপদে গঙ্গা
রাসায়নিক বর্জ্য দূষিত করে গঙ্গার মতো নদীকেও৷ পাশাপাশি বিসর্জনের প্রতিমা বা ফুল-মালায় হচ্ছে জলদূষণ৷ বিপন্ন ছোট মাছ, শামুক এবং বকেরা৷
ছবি: DW/Payel Samanta
ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল!
সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণা অনুযায়ী, কলকাতার সবচেয়ে দূষিত এলাকা ট্যাংরা-তিলজলা৷ তবে শহরের যত্রতত্র এমন ডাঁই করা আবর্জনা দেখলে মনে হবে, সারা শহরটাই দূষিত! ঘুমিয়ে কলকাতা পুরসভা ও রাজ্য প্রশাসন৷
অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখতে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাতে গাছ লাগানোই সঠিক পন্থা৷ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বরানগরে গাছ লাগানোর কর্মসূচিতে শিশুদের পাশে বড়রা৷
ছবি: DW/Payel Samanta
প্রাণের আরাম
কলকাতায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা দেশের বাকি মহানগরগুলির তুলনায় অনেকটা কম৷ গাড়ি-দূষণের মোকাবিলায় রাজপথে রয়েছে সবুজের সমারোহ৷
ছবি: DW/P. Samanta
দূষণ প্রতিরোধে
যানজটের জন্য থমকে থাকা গাড়ির ধোঁয়া দূ্ষণের মাত্রা বাড়ায়৷ তা রুখতে বিকল্প জ্বালানিনির্ভর যানবাহন রাস্তায় নেমেছে৷ তার অন্যতম এলপিজি চালিত অটো৷
ছবি: DW/Payel Samanta
যত্নের অভাব
কর্তব্যের খাতিরে ব্যস্ত রাস্তার ধারে হয়েছে বৃক্ষরোপণ৷ কিন্তু তার ঠিক মতো দেখভাল হয় না৷ জলের অভাবে ধুঁকছে, শুকিয়ে যাচ্ছে গাছ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
বর্জ্য হইতে সাবধান
হাসপাতালে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, অশোধিত কাঁচের যন্ত্রপাতি দূষণ ও সংক্রমণের আকর৷ মাটিতে মিশে যাওয়া জৈব এবং না মিশে যাওয়া অজৈব বস্তুগুলিকে আলাদা রাখাই শ্রেয়৷ আবর্জনা ঘেঁটে যাঁদের জীবিকা নির্বাহ হয়, তাঁদের ভালো রাখা সবার কর্তব্য৷