কলকাতা কি হয়ে উঠতে পারে সাইকেলের শহর
১১ জুন ২০২০করোনা সংক্রমণ রুখতে প্রায় আড়াই মাস বন্ধ ছিল গণপরিবহণ৷ আনলক-এর প্রথম পর্যায়ে গণপরিবহণের একাংশ পথে নামলেও ট্রেন এখনো বন্ধ৷ শহরতলির ট্রেনে করে হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার লাখ লাখ মানুষ রোজ কলকাতায় আসেন৷ এঁদের মধ্যে অনেকেই জরুরি পরিষেবায় যুক্ত৷ দীর্ঘ সময় ট্রেন ও বাস না থাকায় তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারছিলেন না৷ মূলত তাঁরাই সাইকেলকে বেছে নিয়েছেন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে৷ কেউ কিনেছেন নতুন সাইকেল, কেউ আবার ভাঙাচোরা পুরনো যানটি মেরামত করে নিয়েছেন কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য৷
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জলশোধনকারী সংস্থার টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের বাসিন্দা গোপাল সরকার৷ প্রতিদিন ট্রেনে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে আসেন তিনি৷ স্টেশন গ্যারাজে রাখা সাইকেল নিয়ে গৃহস্থের বাড়ি যান জল শোধনের যন্ত্র সারাই করতে৷ লকডাউনের ফলে ট্রেন বন্ধ থাকায় শহরে আসতে পারেননি গোপাল৷ তিনি বলেন, ‘‘একটা নতুন সাইকেল কিনতেই হল৷ এক ঘণ্টা ১০ মিনিট লাগছে বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় যেতে৷ অফিস থেকে বলেই দিয়েছে, বাসে এলে হবে না৷ তাতে সংক্রমণের ভয় থাকবে৷’’
সাইকেলের এই প্রয়োজনের কথা বুঝেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷ তাই যে কলকাতা শহরে সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে উঠে গিয়েছে নিষেধাজ্ঞা৷ কলকাতা পুলিশ এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, এখন কলকাতার রাস্তায় সাইকেল চালানো যাবে৷ তবে বড় রাস্তায় নয়, রাজপথের সমান্তরাল বিভিন্ন রাস্তায় চালানো যাবে সাইকেল৷ এই নির্দেশিকা খুশি রুজি রোজগারে মরিয়া সাধারণ মানুষ৷ গড়িয়ার বাসিন্দা আখলাতুর রহমান রাসবিহারীর একটি দোকানে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যে কোনো ভাবেই কাজে যেতে হত৷ দোকান খুলে গিয়েছে, আমি না গেলে অন্য কাউকে কাজে নিয়ে নেবে৷ বাসে ভিড় হচ্ছে, ভাড়াও বেশি চাইছে৷ এখন সাইকেলই আমাদের ভরসা৷ পুলিশের অনুমতি থাকলে নিশ্চিন্তে যেতে পারব৷’’ পাশাপাশি যানবাহনে সংক্রমণের ভয়ের কারণে লকডাউন পরবর্তী ক্ষেত্রে মানুষের সাইকেলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে৷গত দুমাসে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে৷ সাইকেল মেরামতির দোকানে কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷
এখন শহরের অনেক রাস্তাতেই সাইকেল চালালে আর জরিমানার ভয় নেই৷ গলিঘুঁজির শর্টকাটে না গিয়ে বাস চলাচলের রাস্তা দিয়ে সবাই যাতায়াত করতে পারবেন৷ সাইকেলের ব্যবহার বাড়লে দূষণ কমবে৷ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী নব দত্ত বলেন, ‘‘গণপরিবহণ না থাকার অর্থ ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি সংখ্যায় রাস্তায় নামছে৷ তাতে দূষণও বেড়েছে গত কয়েকদিনে৷ সাইকেলের মতো যান পথে নামলে দূষণের ভয় নেই৷ তাই সাইকেল চালনাকে উৎসাহিত করা উচিত৷ বিদেশে সাইকেল চালকদের জন্য আলাদা লেন থাকে৷ ইউরোপের শহরগুলিতে বাইক চোখে না পড়ুক, অসংখ্য সাইকেল নজরে আসবে৷ দিল্লিতেও আছে সাইকেল চালানোর আলাদা জায়গা৷’’
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শিকাগো ও নিউইয়র্ক শহরে লক ডাউন পর্যায়ে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ১০০ শতাংশ ও ৬৭ শতাংশ৷ কলকাতা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে৷ আদতে এই শহরের মোট আয়তনের তুলনায় রাস্তার অংশ খুবই কম৷ তাই পথচারীর জন্য ফুটপাত তৈরির পর সাইকেলের জন্য পৃথক লেন তৈরির পরিসর থাকে না৷ আলাদা জায়গা নির্দিষ্ট না থাকলে দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা থাকে সাইকেল আরোহীর৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অতীতে সবুজসাথী প্রকল্পের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে সাইকেলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে৷ বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যে বিনামূল্যে লাখ লাখ সাইকেল বিতরণ করা হয়েছে৷ পথের ধারে দেওয়া হয়েছে সেই প্রকল্পের বিজ্ঞাপনও৷
অতীতে কেএমডিএ বাইপাস সম্প্রসারণের সময় সাইকেলের জন্য লেন তৈরি করার কথা ভেবেছিল৷ ভবিষ্যতে কি এমন ভাবনায় কলকাতা সাইকেলের শহর হয়ে উঠতে পারে? খুব একটা আশাবাদী নন নব দত্ত৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কলকাতার পুলিশ রক্ষণশীল৷ যন্ত্রচালিত না হলে অন্যান্য যানবাহন পথে চলতে দিতে তারা রাজি নয়৷ বর্তমান পরিস্থিতি অনুমতি দেওয়া হয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু, গণপরিবহণ স্বাভাবিক হয়ে গেলে সাইকেল আবার নিষিদ্ধের তালিকায় চলে যাবে বলেই আমার মনে হয়৷’’