ভারতের সবচেয়ে সুরক্ষিত শহরের তকমা পেয়েছে কলকাতা৷ এটাকে নিজেদের সাফল্য বলে দাবি করছে পুলিশ-প্রশাসন৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে৷ বিরোধীরা এ জন্য দায়ী করছে রাজ্য সরকারকে৷
বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরো(এনসিবি) সম্প্রতি ২০১৭ সালের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ মেট্রো শহরের সঙ্গে দেশের প্রধান ১৯টি শহরের মধ্যে কলকাতাকে সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷ এই রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক বছরে শহরে অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ কমছে৷ ২০১৪ সালে অপরাধ হয়েছিল ২৬,১৬১টি৷ ২০১৭ সালে অপরাধের সংখ্যা ১৯,৯২৫৷ অপরাধের হার কমেছে ৩১.৩ শতাংশ৷ ২০১৬ সালের রিপোর্টে এই তালিকায় সবার ওপরে ছিল কোয়েম্বাটুর৷ কলকাতা সেই জায়গা নিয়েছে৷ এই শহরের পর তালিকায় রয়েছে কোয়েম্বাটুর, হায়দরাবাদ, কোঝিকোড় ও মুম্বই৷
কেন্দ্রীয় সংস্থার রিপোর্টকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখছে কলকাতা পুলিশ৷ শহরের পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য, "প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও পুলিশকর্মীদের চেষ্টায় এই সাফল্য এসেছে৷ গত চার বছরে অনেক নতুন থানা তৈরি হয়েছে৷ মানুষ সহজে অভিযোগ জানাতে পারছে৷ আমরাও ব্যবস্থা নিতে পারছি৷” এছাড়া গড়ে উঠেছে মহিলা থানা৷ উৎসবের সময় পুলিশ রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে তোলে সহায়তা বুথ৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রয়েছে পুলিশ দফতরের ভার৷ এটাকে তাঁর সাফল্য হিসেবেই দেখছেন তৃণমূল নেতৃত্ব৷ তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের উদ্যোগেই কলকাতাকে নিরাপদ করা গিয়েছে৷ যদিও এনসিবির রিপোর্টকে রাজ্য প্রশাসনের সাফল্য হিসেবে দেখতে চাইছে না বিরোধীরা৷ এটাকে তারা কলকাতার ঐতিহ্য বলেই মনে করছে৷ সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন,‘‘কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী৷ এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এই শহরে গড়ে উঠেছে৷ এখান থেকেই আমরা পেয়েছি ছয়জন নোবেলজয়ীকে৷ এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি৷ সে কারণেই কলকাতার অপরাধ প্রবণতা অন্যান্য শহরের তুলনায় কম৷’’
তন্ময় ভট্টাচার্য
কলকাতা রিপোর্টে সন্তোষজনক অবস্থায় থাকলেও সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা কিন্তু ভাল নয়৷ এনসিবি-র ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের তালিকায় অপরাধের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে তৃতীয় স্থানে৷ ২০১৬ সালে রাজ্যে ৪৬,৭২৩টি অপরাধ হয়েছিল৷ ২০১৭ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ৪৮,৬০৯৷ অপরাধের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের আগে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার৷ এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাম বিধায়ক তন্ময় বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের সাফল্য হলে পশ্চিমবঙ্গে এই হাল কেন? কলকাতাকে সুরক্ষিত রাখার কৃতিত্ব যদি এই সরকারের হয়, একই কৃতিত্ব ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারেরও রয়েছে৷ আদতে এই রাজ্যে এমনভাবে প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে যে, অপরাধ বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক৷’’ তবে তাঁর বক্তব্য, ‘‘শহর মানে একটা সরকার বা চারটে পুলিশ নয়৷ শহর মানে মানুষ৷ সুরক্ষার কৃতিত্ব তাঁদের৷’’
শাশ্বতী ঘোষ
নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে্ও কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা এনসিবির রিপোর্টে আলাদা৷ কলকাতা মহিলাদের জন্য নিরাপদ হলেও রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ অপরাধের তালিকায় তৃতীয়৷ ২০১৭-য় পশ্চিমবঙ্গে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৩০, ৯৯২৷ সে কারণেই শুধু কলকাতার সুরক্ষিত হওয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত নন অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ৷ তিনি বলেন, ‘‘অন্য শহরের সঙ্গে তুলনা করলে কলকাতা অবশ্যই এগিয়ে৷ দিল্লিতে যে দৃষ্টিতে মহিলাদের দেখা হয়, এখানে নিশ্চয়ই তা হয় না৷ কলকাতা দিল্লির তুলনায় নিরাপদ হতেই পারে, কিন্তু দক্ষিণ ভারতের শহরের তুলনায় সুরক্ষিত, এটা মনে হয় না৷’’ কলকাতার সিটি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপিকা শাশ্বতী এই ধরনের রিপোর্ট তৈরির পদ্ধতি নিয়েও সন্দিহান৷ তাঁর মতে, ‘‘নারীদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনাও অভিযোগ দায়েরের মধ্যে ফারাক থাকে৷ ঘটনা ঘটলেও সেটা নথিভুক্ত নাও হতে পারে৷ তাই রিপোর্ট পুরো ছবিটা তুলে ধরে না৷’’ কলকাতায় প্রতিদিন চলাফেরার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আমাদের রাস্তাঘাট খুব স্বস্তিদায়ক বলে আমার মনে হয় না৷ ধর্ষণ পর্যন্ত না গড়ালেও টিটকিরি থেকে শ্লীলতাহানি কিছু কমেনি৷ ভয়ংকর হিংসা না হলেও এসব সমস্যা থাকলে মেয়েরা নিরাপদে, স্বস্তিতে আছে কি করে বলব!’’
কলকাতা: বিপ্লবের আঁতুরঘর
কলকাতার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি৷ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের আঁতুড়ঘর ছিল বাংলা৷ এই শহরেই স্বাধীনতার মুহূর্তে অনশনে বসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পেরিয়ে নজর ইতিহাসের আলো-আঁধারিতে৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়
১৯০২ সালে ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি৷ পি মিত্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এখানে শরীরচর্চা, অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ হতো৷ প্রকাশিত হত সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’৷
ছবি: DW/Payel Samanta
৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি
সশস্ত্র বিপ্লবীদের এই মূল আখড়াতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে বোমা তৈরির মালমশলা উদ্ধার করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় অরবিন্দ ও বারীন ঘোষ সহ একাধিক বিপ্লবীকে৷ শুরু হয় ঐতিহাসিক আলিপুর বোমার মামলা৷ আজ সেই বাগানবাড়ি নেই, তবে বোমার মাঠ টিকে আছে৷ প্রোমোটারের হাত থেকে এই মাঠ রক্ষায় চলছে আন্দোলন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আদালতে
আলিপুর বোমার মামলা ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়৷ এই মামলায় ৩৭ জনের বেশি সন্দেহভাজনের বিচার হয়েছিল আলিপুর জাজেস কোর্টে৷ মৃত্যুদণ্ড, দ্বীপান্তর এবং যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয় বিপ্লবীদের৷
এই কাঠগড়াতেই অপরাধীর ভূমিকায় ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ৷ এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়া, সেকেলে সিলিং ফ্যান, বিচারকের চেয়ার, টাইপরাইটার আজও রয়েছে৷ এই কক্ষেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ বিচারে অরবিন্দ মুক্তি পান৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আলিপুর জেলে ফাঁসির মঞ্চ
এই জেলে বন্দি রাখা হত বিপ্লবীদের৷ আলিপুর বোমা মামলায় বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে এখানেই হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু৷ ১৯০৮ সালে এখানেই তাঁদের ফাঁসি হয়৷ এই জেলে অরবিন্দ ঘোষের ভাগবৎ দর্শন ঘটে৷ নেতাজি থেকে বিধানচন্দ্র রায় এই কারাগারে বন্দি ছিলেন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
শক্তির আরাধনায় বিপ্লবীরা
শক্তিরূপে দেবীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী যুবশক্তিকে সংগঠিত করার প্রয়াসে একসময় দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়৷ ১৯২৬ সালে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর হাত ধরে শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব৷ এখানেও ছিল বিপ্লবীদের শরীরচর্চার আখড়া৷
ছবি: DW/Payel Samanta
প্রাণ হলো বলিদান...
১৯৩০ সালের রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের অভিযানে মারা পড়েন কুখ্যাত পুলিশকর্তা সিম্পসন৷ তারপর এই ভবনের অলিন্দেই ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির লড়াই হয়৷ তিন বিপ্লবীর স্মরণে এই এলাকার নাম বিবাদী বাগ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
পুলিশের জাদুঘর
সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে এই ভবন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের৷ সেখানেই তৈরি হয়েছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম৷ কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত বোমা, আলিপুর বোমা মামলার নথি থেকে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস বা দীনেশ মজুমদারের পিস্তল রয়েছে এই সংগ্রহশালায়৷
ছবি: DW/Payel Samanta
বেলেঘাটায় গান্ধী
কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিলে ছিলেন ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর৷ এখানেই গড়ে উঠেছে গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতার মুহূর্তে
দাঙ্গা থামাতে হায়দারি মঞ্জিলে গান্ধীজি অনশন করেন৷ তাতে থেমেছিল রক্তপাত৷ ৪ সেপ্টেম্বর দাঙ্গাবাজেরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় বাপুর কাছে৷ দুই সম্প্রদায়ের তরফে দেওয়া হয়েছিল শান্তির লিখিত প্রতিশ্রুতিও৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা এলো
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বদেশিয়ানার প্রতীক ছিল গান্ধীর চরকা৷ সাত দশক আগে বাপুর ব্যবহৃত চরকা গান্ধী ভবন সংগ্রহশালার আকর্ষণ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
জীবন যখন বাণী
১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট এই ঘরে বাপু অনশনে বসেছিলেন৷ এখানেই করতেন প্রার্থনা৷ বিশিষ্ট এই ভবনে এসেছেন দিকপাল ব্যক্তিত্বরা৷ তবুও কলকাতার পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস
উত্তর কলকাতার এই বাড়িটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ অথচ সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার এমন বহু স্মারক হারিয়ে যেতে বসেছে৷