1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আমাকেও জীবন দিতে হবে?

জাহিদুল কবির২০ এপ্রিল ২০১৪

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ১৬ ঘণ্টা আটকে থাকার পর উদ্ধার পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু গত এক বছরে যে অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বের মুখোমুখি শিলা বেগমকে হতে হয়েছে – তা থেকে উদ্ধারের পথ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না৷

জার্মানিতে একটি বিক্ষোভে শিলা বেগমছবি: DW/J. Kabir

এই এক বছরে সহায়তা বাবদ সব মিলিয়ে শিলা পেয়েছেন ৭০ হাজার টাকা৷ কিন্তু অকেজো হতে বসা ডান হাতের চিকিৎসাও তাতে ঠিকমতো হচ্ছে না৷

তাঁর ১০ বছর বয়সি মেয়ে নিপা মনির লেখাপড়া অর্থাভাবে বন্ধ হতে চলেছে৷ দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী হারানো শিলা জানেন না – মেয়েকে নিয়ে আগামী দিনগুলো তিনি কীভাবে পার করবেন৷

এমনই সংকটে সম্প্রতি সালমা নামের এক পোশাক শ্রমিকের আত্মহত্যার কথা জানিয়ে বাংলাদেশি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের কাছে শিলা প্রশ্ন রেখেছেন, তাঁকেও কি একই পথ বেছে নিতে হবে?

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া পারভীন (বামে) ও শিলা বেগমছবি: DW/J. Kabir

সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে ইউরোপভিত্তিক সংস্থা ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন' এর আমন্ত্রণে জার্মানি ঘুরে গেলেন আহত এই পোশাক কর্মী৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া পারভীন ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শহীদুল ইসলাম শহীদ৷

গত ১০ এপ্রিল ফ্রাংকফুর্টে এক সংবাদ সম্মলেন বাংলাদেশের এই দুই নারী কর্মী নিজেদের কথা তুলে ধরেন৷ ইউরোপের বিখ্যাত ফ্যাশন চেইন অ্যাডলারের সদরদপ্তরের সামনে এক বিক্ষোভেও তাঁরা অংশ নেন৷

‘দায়িত্ব নিতে হবে ক্রেতাদেরও'

ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে সাফিয়া বলেন, সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানায় বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরির কাজ চলছিল৷ সেইসব কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তারা যাতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়, সেই দাবি নিয়েই তাঁদের জার্মানিতে আসা৷

জার্মানিতে ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন' এর সংবাদ সম্মেলনে শিলাছবি: DW/J. Kabir

‘‘যে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে, তারা অনেক সস্তায় কাজ করিয়ে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করছে৷ সুতরাং শ্রমিকদের জন্য তাদেরও অনেক দায়-দায়িত্ব আছে৷ যে কারখানাকে তারা কাজ দিচ্ছে, তাদের ভবন নিরাপত্তা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ – সব কিছু ঠিক আছে কিনা, সে বিষয়ও তাদের দেখতে হবে৷ জার্মানির ক্রেতাদেরও এ বিষয়ে চাপ দিতে হবে৷''

এ যেন ‘প্রলয়'

শিলা জানান, আট তলা রানা প্লাজার ছয় তলায় ইথার টেক্স-এ সিনিয়র মেশিন অপারেটর ছিলেন তিনি৷ গত বছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনেও নেমে এসেছে দুর্যোগ৷

ওই ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে ১১ শ'রও বেশি মানুষকে, যাঁদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আরো অন্তত দেড় হাজার কর্মী৷

২৩ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে ভবনটিতে ফাটল ধরার পর আতঙ্কিত শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটি চান৷ সেদিন ছুটি দেয়া হলেও পরদিন কর্মীদের আবার কাজে যোগ দিতে বলা হয়৷ হুমকি দেয়া হয় – কাজে না এলে বেতন আটকে যাবে৷

‘‘আমরা সবাই ২৪ এপ্রিল সকালে গেলাম৷ বললাম, এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকব না৷ কিন্তু অফিসের কর্মকর্তারা জোর-জবরদস্তি মারধর করে আমাদের কারখানায় ঢোকাল৷ সকাল ৮টার দিকে আামরা পাঁচ হাজার শ্রমিক কারখানায় ঢুকি এবং কাজ শুরু করি৷ সাড়ে ৮টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর চালু করা হয়৷ সাথে সাথে বিল্ডিংটা যেন একটা ঝাঁকি মারে৷ আমি নীচের দিকে চলে যেতে থাকি৷''

ছাদ থেকে খসে পড়া কংক্রিটের চাঁইয়ে থেতলে যায় শিলার ডান হাত৷ একটা বিম এসে পেটের ওপর পড়লে গুরুতর আহত হন তিনি৷

চারদিকে তখন প্রলয় চলছে৷ ধসে পড়ছে ছাদ, খসে পড়ছে কংক্রিটের বড় বড় চাঙড়৷ তারই মধ্যে ধুলোর মেঘ, আতঙ্কিত কর্মীদের চিৎকার আর বাঁচার জন্য ছুটোছুটি৷

‘‘আমার পাশে দুই জন হেল্পার ছিল, একজন সাথে সাথেই মারা গেল৷ আমার বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকায়ে আল্লাহ পাক বোধহয় আমারে বাঁচাইছে৷''

১৬ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে শিলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন৷ সাভারের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যেখানে তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা৷

কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর হাতের চিকিৎসার জন্য শিলাকে পাঠানো হয় সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে৷ এখনো সেইখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৪ বছর বয়সি এই নারী শ্রমিক৷

তিনি বলেন, ‘‘প্রায় এক বছর হয়ে গেছে, এখনো আমার হাতের ভালো একটা ট্রিটমেন্ট হয় নাই৷ আমি ডান হাতে কোনো শক্তি পাই না৷ আমি এই হাত দিয়ে কাজ করতে পার না, খেতেও পারি না৷''

‘ক্ষতিপূরণ চাই, বাঁচার সুযোগ চাই'

শিলা জানান, তাঁর মেয়ে নিপা মনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, ক্লাসে তার রোল নম্বর ১৷ কিন্তু আর্থিক অনটনে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পথে৷

প্রাইমার্কসহ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেয়া ক্ষতিপূরণ থেকে এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছেন শিলা৷ অন্যদের সহায়তা মিলিয়ে এক বছরে তাঁর হাতে এসেছে ৭০ হাজার টাকার মতো৷ কিন্তু এখন অর্থাভাবে তাঁর সংসার চলে না, হাতের চিকিৎসাও ঠিকমতো হচ্ছে না৷

‘‘আমরা শ্রমিকরা সবাই অসহায়৷ আমাদের চলার পথ বন্ধ৷ আমরা চাই আমাদের চিকিৎসা হোক৷ আমরা চাই আমাদের ক্ষতি পূরণ দেয়া হোক, আমরা চাই ন্যায্য মজুরি; আমরা চাই আমাদের সন্তানরা ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক৷ আমরা এই আশাই করতেছি৷ কিন্তু কিছুই তো হইতেছে না৷''

শিলা বলেন, ‘‘দুই মাস আগে সালমা নামের একটা মেয়ে আর্থিক সমস্যায় আত্মহত্যা করছে৷ আমরা যে ২৯টা বায়ারের কাজ করছি, তারা কি চায় যে আমিও সালমার মতো কষ্টের জ্বালায় জীবন দিয়ে দেই? ওই রানা প্লাজা থেকে আমরা যে নির্মম যন্ত্রণা পেয়ে আসছি, আমাদের প্রতি কি একটু দয়া হয় না? আমাদের ক্ষতিপূরণ কি তারা দিয়ে দিতে পারে না? ''

‘‘আমি আশা করি, অনুরোধ করি, আমাদের ক্ষতিপূণ তারা যেন দিয়ে দেয়, আমাদের বাচ্চাদের আমরা যাতে লেখাপড়া করাতে পারি, যেন নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারি৷''

ট্রেড ইউনিয়ন: বদলাচ্ছে পরিস্থিতি

সাফিয়া পারভীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো কর্মীদের বিভিন্ন সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, প্রয়োজনে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএকে চাপও দেয়৷ কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড বেশ দুর্বল৷ শ্রমিকদের ইউনিয়নে অংশগ্রহণের হার ৩ শতাংশেরও নীচে৷

‘‘মালিকপক্ষের মাস্তানদের হুমকি সামাল দিয়েই সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হয়৷ আবার সরকারও মাঝেমধ্যে চাপ দেয়৷ এগুলো ট্রেড ইউনিয়নের কাজে বাধা৷ তবে পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে ভালো৷ কারণ বর্তমান সরকার অনেকটা শ্রমিকদের পক্ষে৷ সরকার চায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা সামনের দিকে এগিয়ে যাক৷''

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে৷ পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকার প্রথমবারের মতো একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে৷

‘‘সম্প্রতি পোশাক কারখানার ন্যূনতম মজুরি ৭৩ শতাংশ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে৷ রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলাদা একটি তহবিল করা হয়েছে৷ শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে৷''

এছাড়া রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত হয়েছে রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড, যাতে এ পর্যন্ত ৪ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, জমা হয়েছ ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার৷

সাফিয়া জানান, ৮০-র দশকের আগে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটি পেতেন না৷ কাজ করতে হতো মে দিবসেও৷ নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি জুটতো না৷ বেতন, বোনাস নিয়েও অনেক সমস্যা হতো৷

শ্রমিক সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের আন্দোলনে এ সব দাবি অনেকটা পূরণ হয়েছে৷ আগে শ্রমিকরা সব কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পেত না৷ এখন সুযোগ দেয়া হচ্ছে৷

এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘‘এ সব অধিকার আমরা আদায় করতে পেরেছি৷ এটুকুই আমাদের অর্জন৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ