রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ১৬ ঘণ্টা আটকে থাকার পর উদ্ধার পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু গত এক বছরে যে অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বের মুখোমুখি শিলা বেগমকে হতে হয়েছে – তা থেকে উদ্ধারের পথ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না৷
বিজ্ঞাপন
এই এক বছরে সহায়তা বাবদ সব মিলিয়ে শিলা পেয়েছেন ৭০ হাজার টাকা৷ কিন্তু অকেজো হতে বসা ডান হাতের চিকিৎসাও তাতে ঠিকমতো হচ্ছে না৷
তাঁর ১০ বছর বয়সি মেয়ে নিপা মনির লেখাপড়া অর্থাভাবে বন্ধ হতে চলেছে৷ দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী হারানো শিলা জানেন না – মেয়েকে নিয়ে আগামী দিনগুলো তিনি কীভাবে পার করবেন৷
এমনই সংকটে সম্প্রতি সালমা নামের এক পোশাক শ্রমিকের আত্মহত্যার কথা জানিয়ে বাংলাদেশি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের কাছে শিলা প্রশ্ন রেখেছেন, তাঁকেও কি একই পথ বেছে নিতে হবে?
সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে ইউরোপভিত্তিক সংস্থা ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন' এর আমন্ত্রণে জার্মানি ঘুরে গেলেন আহত এই পোশাক কর্মী৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া পারভীন ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শহীদুল ইসলাম শহীদ৷
গত ১০ এপ্রিল ফ্রাংকফুর্টে এক সংবাদ সম্মলেন বাংলাদেশের এই দুই নারী কর্মী নিজেদের কথা তুলে ধরেন৷ ইউরোপের বিখ্যাত ফ্যাশন চেইন অ্যাডলারের সদরদপ্তরের সামনে এক বিক্ষোভেও তাঁরা অংশ নেন৷
‘দায়িত্ব নিতে হবে ক্রেতাদেরও'
ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে সাফিয়া বলেন, সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানায় বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরির কাজ চলছিল৷ সেইসব কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তারা যাতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়, সেই দাবি নিয়েই তাঁদের জার্মানিতে আসা৷
‘‘যে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে, তারা অনেক সস্তায় কাজ করিয়ে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করছে৷ সুতরাং শ্রমিকদের জন্য তাদেরও অনেক দায়-দায়িত্ব আছে৷ যে কারখানাকে তারা কাজ দিচ্ছে, তাদের ভবন নিরাপত্তা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ – সব কিছু ঠিক আছে কিনা, সে বিষয়ও তাদের দেখতে হবে৷ জার্মানির ক্রেতাদেরও এ বিষয়ে চাপ দিতে হবে৷''
এ যেন ‘প্রলয়'
শিলা জানান, আট তলা রানা প্লাজার ছয় তলায় ইথার টেক্স-এ সিনিয়র মেশিন অপারেটর ছিলেন তিনি৷ গত বছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনেও নেমে এসেছে দুর্যোগ৷
ওই ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে ১১ শ'রও বেশি মানুষকে, যাঁদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আরো অন্তত দেড় হাজার কর্মী৷
রানা প্লাজায় আহতদের সহায়তায় জার্মানিতে প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসে আহত পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় জার্মানির বিলেফেল্ড শহরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ একটি গির্জায় আয়োজিত এই প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হবে আহত শ্রমিকদের সহায়তায়৷
ছবি: DW/A. Islam
বিলেফেল্ডে প্রদর্শনী
জার্মানির বিলেফেল্ড শহরের একটি গির্জায় ২৬ জানুয়ারি প্রদর্শন করা হয় একদল পোশাক শ্রমিকের ছবি, যাঁরা রানা প্লাজা ধসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত৷ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য, ২০১৩ সালের ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এ সব মানুষ সম্পর্কে জার্মানদের জানানো৷ পাশাপাশি তাঁদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ৷
ছবি: DW/A. Islam
শুধু ছবি নয়
বিলেফেল্ডে গির্জার পাশের সম্মেলন কক্ষে পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন ছবির পাশেই শোভা পাচ্ছিল কিছু টি-শার্ট৷ সাদা এই টি-শার্টের উপরে লেখা রয়েছে ‘ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন’৷
ছবি: DW/A. Islam
উৎসুক দৃষ্টি
একটি ছবির ক্যাপশনের দিকে প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের উৎসুক দৃষ্টি৷
ছবি: DW/A. Islam
ছিলেন বাঙালিরাও
বিলেফেল্ডে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছবি প্রদশনীটি দেখতে গির্জায় হাজির হন৷ সাভারে পোশাক শ্রমিকদের করুণ পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত তাঁরা৷
ছবি: DW/A. Islam
গির্জার ভেতরে
গির্জায় রবিবার প্রার্থনা সভা চলাকালে বাংলাদেশের এই ছবিটিসহ আরো কয়েকটি ছবি প্রদর্শন করা হয় প্রার্থনা কক্ষের ভেতরেই৷ বাংলাদেশ সম্পর্কে জার্মানির আমজনতাকে ধারণা দেওয়ার ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ স্থানীয় গণমাধ্যমেও সাড়া জাগিয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
আয়োজকের কথা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে স্বেচ্ছাসেবী ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷ ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা জানতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন তিনি৷ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারোশ’র বেশি মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হন, যাঁদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক৷
ছবি: DW/A. Islam
অর্থ যাচ্ছে স্নেহা ফাউন্ডেশনে
ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন জানান, প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ স্নেহা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় খরচ করা হবে৷ ফাউন্ডেশনটি ৩০ জন নারী পোশাক শ্রমিকের দীর্ঘমেয়াদি পুর্নবাসনের দায়িত্ব নিয়েছে, যাঁরা ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মা৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
২৩ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে ভবনটিতে ফাটল ধরার পর আতঙ্কিত শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটি চান৷ সেদিন ছুটি দেয়া হলেও পরদিন কর্মীদের আবার কাজে যোগ দিতে বলা হয়৷ হুমকি দেয়া হয় – কাজে না এলে বেতন আটকে যাবে৷
‘‘আমরা সবাই ২৪ এপ্রিল সকালে গেলাম৷ বললাম, এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকব না৷ কিন্তু অফিসের কর্মকর্তারা জোর-জবরদস্তি মারধর করে আমাদের কারখানায় ঢোকাল৷ সকাল ৮টার দিকে আামরা পাঁচ হাজার শ্রমিক কারখানায় ঢুকি এবং কাজ শুরু করি৷ সাড়ে ৮টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর চালু করা হয়৷ সাথে সাথে বিল্ডিংটা যেন একটা ঝাঁকি মারে৷ আমি নীচের দিকে চলে যেতে থাকি৷''
ছাদ থেকে খসে পড়া কংক্রিটের চাঁইয়ে থেতলে যায় শিলার ডান হাত৷ একটা বিম এসে পেটের ওপর পড়লে গুরুতর আহত হন তিনি৷
চারদিকে তখন প্রলয় চলছে৷ ধসে পড়ছে ছাদ, খসে পড়ছে কংক্রিটের বড় বড় চাঙড়৷ তারই মধ্যে ধুলোর মেঘ, আতঙ্কিত কর্মীদের চিৎকার আর বাঁচার জন্য ছুটোছুটি৷
‘‘আমার পাশে দুই জন হেল্পার ছিল, একজন সাথে সাথেই মারা গেল৷ আমার বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকায়ে আল্লাহ পাক বোধহয় আমারে বাঁচাইছে৷''
১৬ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে শিলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন৷ সাভারের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যেখানে তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা৷
পোশাক শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন সম্প্রতি গিয়েছিলেন একটি পোশাক কারখানায়৷ তাঁর অভিজ্ঞতা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
ঢাকার পূর্ব রামপুরার টিএম গার্মেন্টস-এর এই কর্মীরা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যত৷ কারণ তাঁদের এখানে শ্রম আইন এবং মজুরি বোর্ড পুরোপুরি কার্যকর নেই৷ তাঁদের অগ্নিনিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়৷ এমনকি ভবনটিও পুরনো৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সংসার চালানো কষ্টকর
টিএম গার্মেন্টস-এর পোশাক কর্মী সুফিয়া বেগম যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালান কষ্টকর৷ তবুও তার এরচেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ নেই৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সর্বনিম্ন বেতনও পান না
সর্বনিম্ন বেতন ৩০০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও রাহেলা আক্তার তা পান না৷ তাঁকে বেতন দেয়া হয় ২৫০০ টাকা৷ সে নতুন বলেই তাঁকে নাকি কম বেতন দেয়া হয়৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
নতুন, তাই বেতন কম
সুমি বেগমেরও বেতন অনেক কম৷ কারণ তিনিও নতুন৷ খরচে পোষায় না বলে তাঁরা পাঁচজন মিলে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
গেটে তল্লাশি
এই পোশাক কর্মীদের গার্মেন্টস-এ প্রবেশ এবং বের হওয়ার আগে গেটে তল্লাশী চালানো হয়৷ আর ‘ফ্রেশ’ হতে গেলেও বলে যেতে হয়৷ আর ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে মেলে গালমন্দ৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন এঁরা৷ তাপ ওপর মেশিনপত্রও পুরনো৷ কাজ করতে গিয়ে পুরনো মেশিনপত্রের কোনো ক্ষতি হলে কখনো কখনো জরিমানাও করা হয় তাঁদের৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রঙিন স্বপ্ন
রঙিন পোশাক আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসেন কুড়িগ্রামের মৌসুমী৷ পোশাক কারখানায় কাজ নেয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
শ্রমিকরা অপুষ্টির শিকার
আছিয়া বেগমকে দেখেই বোঝা যায় তিনি অপুষ্টির শিকার৷ সকাল-সন্ধ্যা গার্মেন্টস-এ কাজ করেও তিনি জোটাতে পারেন তাঁর প্রয়োজনীয় খাবার৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
8 ছবি1 | 8
কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর হাতের চিকিৎসার জন্য শিলাকে পাঠানো হয় সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে৷ এখনো সেইখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৪ বছর বয়সি এই নারী শ্রমিক৷
তিনি বলেন, ‘‘প্রায় এক বছর হয়ে গেছে, এখনো আমার হাতের ভালো একটা ট্রিটমেন্ট হয় নাই৷ আমি ডান হাতে কোনো শক্তি পাই না৷ আমি এই হাত দিয়ে কাজ করতে পার না, খেতেও পারি না৷''
‘ক্ষতিপূরণ চাই, বাঁচার সুযোগ চাই'
শিলা জানান, তাঁর মেয়ে নিপা মনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, ক্লাসে তার রোল নম্বর ১৷ কিন্তু আর্থিক অনটনে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পথে৷
প্রাইমার্কসহ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেয়া ক্ষতিপূরণ থেকে এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছেন শিলা৷ অন্যদের সহায়তা মিলিয়ে এক বছরে তাঁর হাতে এসেছে ৭০ হাজার টাকার মতো৷ কিন্তু এখন অর্থাভাবে তাঁর সংসার চলে না, হাতের চিকিৎসাও ঠিকমতো হচ্ছে না৷
‘‘আমরা শ্রমিকরা সবাই অসহায়৷ আমাদের চলার পথ বন্ধ৷ আমরা চাই আমাদের চিকিৎসা হোক৷ আমরা চাই আমাদের ক্ষতি পূরণ দেয়া হোক, আমরা চাই ন্যায্য মজুরি; আমরা চাই আমাদের সন্তানরা ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক৷ আমরা এই আশাই করতেছি৷ কিন্তু কিছুই তো হইতেছে না৷''
শিলা বলেন, ‘‘দুই মাস আগে সালমা নামের একটা মেয়ে আর্থিক সমস্যায় আত্মহত্যা করছে৷ আমরা যে ২৯টা বায়ারের কাজ করছি, তারা কি চায় যে আমিও সালমার মতো কষ্টের জ্বালায় জীবন দিয়ে দেই? ওই রানা প্লাজা থেকে আমরা যে নির্মম যন্ত্রণা পেয়ে আসছি, আমাদের প্রতি কি একটু দয়া হয় না? আমাদের ক্ষতিপূরণ কি তারা দিয়ে দিতে পারে না? ''
‘‘আমি আশা করি, অনুরোধ করি, আমাদের ক্ষতিপূণ তারা যেন দিয়ে দেয়, আমাদের বাচ্চাদের আমরা যাতে লেখাপড়া করাতে পারি, যেন নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারি৷''
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ট্রেড ইউনিয়ন: বদলাচ্ছে পরিস্থিতি
সাফিয়া পারভীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো কর্মীদের বিভিন্ন সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, প্রয়োজনে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএকে চাপও দেয়৷ কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড বেশ দুর্বল৷ শ্রমিকদের ইউনিয়নে অংশগ্রহণের হার ৩ শতাংশেরও নীচে৷
‘‘মালিকপক্ষের মাস্তানদের হুমকি সামাল দিয়েই সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হয়৷ আবার সরকারও মাঝেমধ্যে চাপ দেয়৷ এগুলো ট্রেড ইউনিয়নের কাজে বাধা৷ তবে পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে ভালো৷ কারণ বর্তমান সরকার অনেকটা শ্রমিকদের পক্ষে৷ সরকার চায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা সামনের দিকে এগিয়ে যাক৷''
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে৷ পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকার প্রথমবারের মতো একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে৷
‘‘সম্প্রতি পোশাক কারখানার ন্যূনতম মজুরি ৭৩ শতাংশ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে৷ রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলাদা একটি তহবিল করা হয়েছে৷ শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে৷''
এছাড়া রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত হয়েছে রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড, যাতে এ পর্যন্ত ৪ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, জমা হয়েছ ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার৷
সাফিয়া জানান, ৮০-র দশকের আগে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটি পেতেন না৷ কাজ করতে হতো মে দিবসেও৷ নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি জুটতো না৷ বেতন, বোনাস নিয়েও অনেক সমস্যা হতো৷
শ্রমিক সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের আন্দোলনে এ সব দাবি অনেকটা পূরণ হয়েছে৷ আগে শ্রমিকরা সব কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পেত না৷ এখন সুযোগ দেয়া হচ্ছে৷
এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘‘এ সব অধিকার আমরা আদায় করতে পেরেছি৷ এটুকুই আমাদের অর্জন৷''