কাকদ্বীপে শিক্ষককে পেটালো তৃণমূল নেতা। পুলিশ জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করায় সেই নেতা দ্রুত জামিনে মুক্ত। নদিয়ায় বিজেপি কর্মী খুন। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকেই৷
কাকদ্বীপ ও নদিয়ার ঘটনা নিয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছবি: Subrata Goswami/DW
বিজ্ঞাপন
কাকদ্বীপের বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিলনকান্তি পালকে স্কুলের ভিতর ঢুকে পড়ুয়াদের সামনে মারলো পঞ্চায়েত সদস্য, স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি ও তৃণমূল নেতা ত্রিদিব বারুই।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হয়, বুকে ও পেটে ঘুসি মারা হয়। স্কুলের করিডোর দিয়ে শিক্ষককে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো ঘটনা ধরা পড়ে সিসিটিভি ক্যামেরায়।
গ্রেপ্তার ও জামিন
এই ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পুলিশের কাছে এফআইআর করেন। প্রবল জনরোষের মুখে পুলিশ অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু পাঁচটি ধারায় মামলা করা হলেও সবই জামিন-যোগ্য, ফলে সহজেই জামিন পেয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই শিক্ষককে পেটানো তৃণমূল নেতা।
বুধবার সন্ধ্যায় অভিযুক্ত ত্রিদিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ । ধৃতের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায়সংহিতার ১২৬ (২) ধারায় (জোর করে আটকে রাখা), ১১৫ (২) (মারধর), ১১৭ (২) (গুরুতর আঘাত), ৩৫১ (২) (ভয় দেখানো) এবং ৩ (৫) (ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে ত্রিদিবকে কাকদ্বীপ মহাকুমা আদালতে তোলা হলে তিনি জামিন পেয়ে যান। এরপরই অভিযোগ ওঠে, পুলিশ গুরুতর ধারা দেয়নি বলে তিনি সহজেই জামিন পেয়েছেন।
নিগৃহীত শিক্ষক বলেন, ‘‘এটা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। এত তাড়াতাড়ি ত্রিদিব জামিন পাবেন ভাবিনি। আমার মনে হয়, পুলিশ লঘু ধারায় মামলা দেওয়াতেই তিনি জামিন পেয়ে গিয়েছেন। এরপরেও উনি যদি বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি থাকেন, তাহলে আমার আশঙ্কা, আবার আমার উপর একইরকমভাবে হামলা হতে পারে।''
তিনি বলেছেন, ''যেভাবে জোরে ঠেলেছেন, আমি উচ্চ রক্তচাপের রোগী, আমি তো মারাই যেতে পারতাম। এই জামিন অদৃষ্টের অন্ধ পরিহাস।''
তৃণমূল নেতার আইনজীবী প্রদীপ নায়েক বলেছেন, ''জামিনযোগ্য ধারা ছিল। তাই আদালত জামিন মঞ্জুর করেছে।''
কী বলছেন সাবেক পুলিশ কর্তারা?
রাজ্য পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এজিডি নজরুল ইসলাম বলেছেন, ''একজন সরকারি কর্মীকে তার ডিউটিতে বাধা দেওয়া অবশ্যই জামিন অযোগ্য অপরাধ। ১৩২ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে এটা জামিন অযোগ্য অপরাধ। এই ধারা দেওয়া হলে জামিন না-ও হতে পারতো।''
সন্দেশখালি : তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করলেন বিক্ষুব্ধ নারীরা
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অজিত মাইতিকে লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করেন নারীরা। নারীদের হাত থেকে বাঁচতে এক বাড়িতে ঢুকে ভিতর থেকে তালা মেরে দেন অজিত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের তাড়া
অজিত মাইতি হলেন সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের কাছের মানুষ। তার বিরুদ্ধেও জমি জবরদখল করাসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। রবিবার তাকে দেখামাত্রই তাড়া করেন সন্দেশখালির নারীরা। তাদের হাতে ছিল লাঠি, ঝাঁটা। তাদের দাবি ছিল, অজিত মাইতিকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সেই বাড়ি
প্রাণের ভয়ে অজিত এই বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। চার ঘণ্টা এ বাড়িতেই ছিলেন। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে সেখান থেকে আটক করে। সোমবার সকালে জানানো হয়, পুলিশ অজিত মাইতিকে গ্রেপ্তার করেছে। এতদিন অজিত মাইতিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। নারীরা তাড়া করার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অজিত মাইতির বাড়ি
এই বাড়িটি অজিত মাইতির। সকাল থেকে তিনি বাড়িতে ছিলেন না। বাড়ি ছিল পুরো শুনশান। পরে তাকে দেখতে পান নারীরা। দেখার সঙ্গে সঙ্গে অজিত মাইতি পালিয়ে গিয়ে একটা বাড়িতে লুকিয়ে পড়ে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের বিক্ষোভ চলছে
সন্দেশখালির বেড়মজুরের নারীরা এবার তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি হলধপ আড়ির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। অজিত মাইতিকে সরিয়ে হলধরকেই অঞ্চল সভাপতি করে তৃণমূল। কিন্তু রাতে তার খড়ের গাদায় আগুন ধরানো হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সাবেক পঞ্চায়েত সদস্য তপন সর্দার ও বর্তমান সদস্য শঙ্কর হালদারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন নারীরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অনেক অভিযোগ
সন্দেশখালিতে একাধিক অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র খুলেছে পুলিশ। সেখানে গিয়ে মানুষ তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন। সেখানেই একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ছে। অধিকাংশই হলো জমি জবরদখল, অত্যাচার ও নারীনিগ্রহের। পুলিশ সব অভিযোগ লিখে নিচ্ছে। প্রশাসনের তরফ থেকে এবং রাজ্যের মন্ত্রীদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে এবং জবরদখল জমি ফেরত দেয়া হবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
একজন অভিযোগকারী
এই অভিযোগকারী বেড়মজুরের। তার জমি জবরদখল করা হয়েছিল। এর জমি নিয়ে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছিল। টাকা চাইতে গেলেই মারধর করা হতো।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হামলার শিকার এক গ্রামবাসী
এই মানুষটি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন, শেখ শাহজাহানের নির্দেশে সিরাজ ও অজিত মাইতি মিলে তার বাড়িতে হামলা করে। ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। তার ছেলেরা এখনো ঘরছাড়া। তিনি আয়লা, আমফানের ত্রাণের টাকাও পাননি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শেখ শাহজাহান কোথায়?
সন্দেশখালি-কাণ্ডে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে। তার তিন সহযোগী উত্তম সর্দার, শিবু হাজরা ও অজিত মাইতিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু শেখ শাহজাহান এখনো ফেরার। তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পুলিশ এখনো তার খোঁজ পায়নি। স্থানীয় মানুষের জানিয়েছেন, কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে বলা হতো, শাহজাহানের কাছে যেতে, শাহজাহানই নাকি বিচার করে দেবেন। বেড়মজুরে এই বিচার করত শাহজাহানের ভাই সিরাজ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সেখানে এখন শুধু পুলিশ
বেড়মজুরে কাঠপোল এলাকায় চারপাশে শুধু পুলিশ। একসময় যেখানে পুলিশের দেখা পাওয়া যেত না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন সেখানে কিছুটা দূরদূর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সারাদিন ধরে টহল
পুলিশ সারাদিন ধরে এলাকায় টহল দিচ্ছে। তারা এখন অতি-সক্রিয়। কিন্তু তাই বলে বিক্ষোভ থামছে না। সমানে চলছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পুলিশি নজরদারি
এভাবে পুলিশ নজর রাখছে চারিদিকে। এলাকাবাসীর বক্তব্য- একসময় তারা চাইতেন পুলিশ আসুক এবং তাদের অভিযোগের সুরাহা করুক। কিন্তু তখন তাদের এখানে দেখা যেতো না। শেখ শাহজাহানদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
টাকা ফেরত এবং বিধায়কের দাবি
সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর দাবি, স্থানীয় মানুষ এখনো শেখ শাহজাহানের নামে কোনো অভিযোগ করেননি। ইতিমধ্যে তারা সন্দেশখালির মানুষকে ডেকে ডেকে টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে টাকাটা নিয়েছিল কারা? যদি শেখ শাহজাহান ও তার দলবল জোর করে টাকা না নিয়ে থাকে, তাহলে ফেরতই বা দিচ্ছেন কেন?
ছবি: Subrata Goswami/DW
টাকা ফেরত এবং বিধায়কের দাবি
সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর দাবি, স্থানীয় মানুষ এখনো শেখ শাহজাহানের নামে কোনো অভিযোগ করেননি। ইতিমধ্যে তারা সন্দেশখালির মানুষকে ডেকে ডেকে টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে টাকাটা নিয়েছিল কারা? যদি শেখ শাহজাহান ও তার দলবল জোর করে টাকা না নিয়ে থাকে, তাহলে ফেরতই বা দিচ্ছেন কেন?
ছবি: Subrata Goswami/DW
13 ছবি1 | 13
সাবেক পুলিশ কর্তা সলিল ভট্টাচার্য মনে করেন, ''ওই শিক্ষক বয়স্ক মানুষ। অনেক অসুস্থতা আছে। তাই এটাকে হত্যার চেষ্টা বলতে হবে।''
কিন্তু কাকদ্বীপের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ''উপযুক্ত ধারায় মামলা করা হয়েছে।''
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''পুলিশ আক্রান্তের পাশে নয়, আক্রমণকারীর পাশে দাঁড়াবে। তৃণমূলের নেতা, তাই জামিনযোগ্য, তাই জামিন, এসব তো ছ্যাবলামো হচ্ছে।''
তবে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ''খারাপ ঘটনা। পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। বিুষয়টি আদালতে গেছে। অন্যপক্ষ আদালতে কী বললেন? জামিন দেওয়া না দেওয়া তো বিচারকের সিদ্ধান্ত।''
বিজ্ঞাপন
নদিয়ায় বিজেপি কর্মী খুন
বুধ ও বৃহস্পতিবারের দিবাগত রাতে নদিয়ার নবদ্বীপ পুরসভার প্রাচীন মায়াপুরে এক বিজেপি কর্মীকে ঘুম থেকে তুলে নৃশংসভাবে মারধর করে দুষ্কৃতীরা। তারপর তারা সারা রাত বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করে। আতঙ্কে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারেনি পরিবার। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সঞ্জয় ভৌমিকের মৃত্যু হয়।
সঞ্জয়ের মা বলেছেন, ''তাপস দেবনাথ যে এমএলএ বা বিধায়কের গাড়ি চালায়, সে মেরেছে। তার সঙ্গে থাকা সন্তু, দীপঙ্কর, তাপস দাস কী করে জানি না।'' তিনি টিভি৯-কে এ-ও বলেছেন, ''থানায় জানিয়ে কিছু হয় না। দেশে আইন নেই, বিচার নেই। আছে শুধু দুর্নীতি, অন্য়ায় ও গরিবের উপর অত্যাচার।''
শোকসন্তপ্ত মা আরো বলেন, ''আমি আর কিছু চাই না। ওই ছেলেদের একবার সামনে চাই। ওদের তো লুকিয়ে রেখেছে।''
স্থানীয় বিজেপি নেতা শশধর নন্দী বলেছেন, ''তৃণমূলের আশ্রিত গুণ্ডারা সেভেন স্টার ক্লাবে ঢুকে প্রথমে ওকে মারধর করে। সেখান থেকে ছেলেটি বাড়ি ঢুকলে সেখানে গিয়ে মারে। আমরা দোষীদের উপযুক্ত সাজা চাইছি।''
পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে কেউ এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
কাকদ্বীপ ও নদিয়ার ঘটনার মধ্য়ে মিল হলো, দুই জায়গাতেই তৃণমূলের নেতা ও কর্মীরা অভিযুক্ত। দুই জায়গাতেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আক্রান্ত বা তার পরিবার।