প্যাপাইরাস, পেপার, কাগজ৷ এই কম্পিউটারের যুগেও সেই আদিম বস্তুটির উপযোগিতা শেষ হয়নি, কেননা মানুষ যতোটা সৃজনশীল, কাগজ ঠিক ততোটাই বহুরূপী৷
বিজ্ঞাপন
বহুরূপী কাগজ
04:06
লেটারবক্সে এ ধরনের একটি আমন্ত্রণ পেলে কার না ভালো লাগে, বলুন – কেননা নিমন্ত্রণপত্রটিই তো একটি শিল্প! পেপারলুক্স নামের একটি ডিজাইন সংস্থা এ ধরনের নিমন্ত্রণপত্র ছেপে থাকে৷
পেপারলুক্স-এর পেপার ডিজাইনার সোরাইয়া ক্যুনে বলেন, ‘‘কাগজ এমন একটা জিনিস, যার বৈচিত্র্যের কোনো শেষ নেই৷ প্রতি বছর অসংখ্য নতুন ধরনের কাগজ বেরোচ্ছে৷ ফ্রান্সে একটা কাগজ তৈরি হচ্ছে, যা দারুণ: কারো তা হাতে নিলে গা ঘিন ঘিন করে; আবার কেউ বলেন, কি সুন্দর...’’
গাছের লতা-পাতা আর আবর্জনা থেকে মুখোশ!
নিজের দেশ ঘানাকে সব অর্থেই পরিচ্ছন্ন দেখতে চান তিনি৷ এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়া তাই গাছের শুকনো পাতা কুড়ান, গাছের কষ সংগ্রহ করেন আর সংগ্রহ করেন বিশেষ কিছু আবর্জনা৷ সব মিলিয়ে তৈরি করেন খুব সুন্দর সুন্দর মুখোশ৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
একটি কণ্ঠই গড়ে দিতে পারে পার্থক্য
এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়া একজন জাত শিল্পী৷ তাই হয়ত আবর্জনাতেও তিনি শিল্প খোঁজেন৷ অসংখ্য মুখোশ তৈরি করে তিনি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চান একটি বার্তা – ঘানার মানুষদের ময়লা আবর্জনা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে৷ শুরুতে প্রয়াসটা ছিল একার, কিন্তু এখন তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিলছে অনেক কণ্ঠ৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
দীর্ঘস্থায়ী হোক আশা
এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়ার কর্মদর্শনের মূল কথাই হলো ‘আশা’৷ তাঁর আশা, গাছের শুকনো পাতা, গাছের ছাল, গাছের কষ আর নানা ধরনের ফেলে দেয়া শক্ত কাগজ বা বোর্ড দিয়ে তৈরি মুখোশগুলো ধীরে ধীরে সমাজের সবাইকে আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
যেভাবে তৈরি হয় অপূর্ব সুন্দর মুখোশ
গাছের পাতা, ছাল এবং কষের সঙ্গে কার্ডবোর্ডের টুকরোগুলো মিশিয়ে প্রথমে সেগুলো দিয়ে মণ্ড তৈরি করেন এড ফ্র্যাংকলিন৷ পরে সেই মণ্ড দিয়েই তৈরি করেন মুখোশ৷ শুনতে সহজ মনে হলেও কাজটা কিন্তু কঠিন৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
আবর্জনার সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে
সবার ভাবনা যখন ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে রিসাইকেল করার মাঝে আটকে আছে, সেখানে এড ফ্র্যাংকলিন ভাবছেন, মানুষকেও ‘রিসাইকেল’ করার কথা৷ নানান অপরাধে যারা জেল খাটছেন, তাদের সম্পর্কে প্রায়ই ভাবেন তিনি৷ এড মনে করেন, সেই মানুষগুলোকে কারাগার থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করা দরকার৷ এবং তাঁর বিশ্বাস, এ কাজে খুব ভালো সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে মুখোশ৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
আর একা নন
শুরুতে মুখোশ তৈরির সব উপাদান নিজেকেই সংগ্রহ করতে হতো৷ এখন ঘরে বসেই পেয়ে যান অনেক কিছু৷ অচেনা-অজানা মানুষরাও শুকনো পাতা, পুরোনো কার্ডবোর্ড বা হার্ডবোর্ড যা-ই পান, নিয়ে এসে তুলে দেন ফ্র্যাংকলিনের হাতে৷ তাঁরা জানেন, এ সব ফেলে না দিয়ে ফ্র্যাংকলিনকে দিলে সবারই উপকার৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
স্বপ্নের আকাশ
অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ‘উইকাকাই’ নামের একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়া৷ আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি সব আবর্জনা রিসাইকেল করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করাও এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
নানা মুখ, নানা মুখোশ
শুধু কোনো রকমে অবয়ব ঢেকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই মুখোশ তৈরি করেন না এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়া৷ প্রত্যেকটি মুখোশের পেছনে একটি বিশেষ ভাবনা থাকে৷ শিল্পী জানালেন, ‘‘প্রতিটি মুখোশই বহুবিধ মানসিক শক্তি এবং বিশ্বকে দেখার বৈচিত্রপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অভিনব প্রকাশ৷’’
ছবি: Ed Franklin Gavua
আবর্জনা অমূল্য রতন
এড ফ্র্যাংকলিন গাভুয়া তাঁর সমস্ত কাজকর্মের মাধ্যমে আর যে কথাটা বোঝাতে চান, তা হলো – আবর্জনা হেলাফেলার জিনিস নয়৷ তাঁর মতে, আবর্জনা যত্রতত্র ফেলা ক্ষতিকর, তবে তা যথাস্থানে রাখা বা রিসাইকেল করার উদ্যোগ অতি জনকল্যাণকর, কেননা, তাতে পরিবেশ রক্ষা হয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ে৷
ছবি: Ed Franklin Gavua
8 ছবি1 | 8
কাগজ একটি নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু, অথচ তার সঙ্গে অনেক আবেগ-অনুভূতি জড়িত থাকে৷ পেপারলুক্সে কাগজ থেকে নানা ধরনের জিনিস তৈরি করা হয়৷ কোনো বাঁধাধরা জিনিস নয়, ‘অ্যার্মেস’ ফ্যাশন লেবেলের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক খরিদ্দারদের ফরমায়েশ অনুযায়ী তৈরি সব একক পণ্য৷ সেক্ষেত্রে এ ধরনের চোখধাঁধানো, দামি নিমন্ত্রণপত্র খুব কাজে আসে৷
সোরাইয়া ক্যুনে জানালেন, ‘‘এটা হল চীনের একটি নিমন্ত্রণপত্র, যা দেখলেই বোঝা যায়৷ একে বলে ডিওরামা; কাগজের অনেক পাতা একসঙ্গে জুড়ে তৈরি করা হয়েছে৷ সব কিছু হাতে তৈরি, কোনো কিছু ছাপা বা রং করা হয়নি৷ আমরা শুধু একটা মোটা কাগজকে পাতে পাতে কেটে জোড়া দিয়েছি৷’’
পেপারলুক্স কোম্পানি
পেপারলুক্সের মালিক হলেন ক্যুনে দম্পতি মাক্স এবং সোরাইয়া৷ কর্মীর সংখ্যা বেশি নয়, সাকুল্যে আটজন৷ কোম্পানিটির পিছনে সৃজনীশক্তি হলেন মাক্স ক্যুনে৷ তিনি পেশায় নেমপ্লেট ও প্ল্যাকার্ড আঁকার শিল্পী৷ কারখানায় তিনি রোজ নিজেই হাত লাগান – যেমন এখানে হামবুর্গের আলস্টার হ্রদের ধারে অবস্থিত একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টের মেন্যুকার্ড তৈরি হচ্ছে৷
পেপারলুক্স-এর ক্রিয়েটিভ ডাইরেক্টর মাক্স ক্যুনে বললেন, ‘‘পদার্থটা অনুভব করতে পারা আমাদের কাজের একটা বড় অংশ৷ পদার্থ কল্পনা করে নেওয়া যায় না৷ কাগজ নিয়ে ইন্টারনেটে কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছে, বলা হয়েছে, ভেবে নাও ওয়েবসাইটের পটভূমিটা হল এক ধরনের কাগজ৷ কিন্তু কাগজ হাতে নেবার যা অনুভূতি, তা কখনও ওভাবে পাওয়া সম্ভব নয়৷’’
কাগজ আবিষ্কৃত হয় প্রায় দু’হাজার বছর আগে৷ আজ হাইটেক প্রয়োগ করে সেই কাগজ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে৷ পেপারলুক্সের পেটেন্ট করা এই প্রক্রিয়ায় একটি ‘লেজার কাটার’ কাগজের সবচেয়ে ওপরের স্তরটি পুড়িয়ে দিচ্ছে – যার ফলে মিলিমিটার পর্যন্ত নিখুঁত নকশা ও অক্ষর ছাপা হচ্ছে৷ তবে কম্পিউটার সব কিছু একা করতে পারে না৷
অস্বাভাবিক কিন্তু চমৎকার কিছু জিনিস
সাইকেলের টায়ার দিয়ে ব্যাগ বা কাগজ দিয়ে পোশাক তৈরি করলে কেমন হয়? আসলে এমন অস্বাভাবিক উপাদানে কিন্তু অনেক দরকারি জিনিসই তৈরি করেছেন ডিজাইনাররা৷ দেখতে সুন্দর হয়েছে, ক্রেতাও লুফে নিয়েছে৷ দেখুন তেমন কিছু পণ্য...৷
ছবি: Jannes Frubel
অভিনব ব্যাগ
ফ্যাশন ডিজাইনার কাটিয়া ভ্যারনারের কাজই হলো কোনো মোটর সাইকেল, বাইসাইকেল বা কোনো গাড়ির টায়ার নষ্ট হলে তা নিয়ে এসে কাজে লাগানো৷ পুরোনো টায়ার দিয়ে ফ্যাশনেবল ব্যাগ থেকে শুরু করে অনেক জিনিসই তৈরি করেন তিনি৷
ছবি: K.W.D.
কাগজের পোশাক
ইউল ওয়াইবেল নজর কেড়েছেন কাগজের পোশাক তৈরি করে৷ তিন মিটার কাগজ পেলে তিন ঘণ্টার মধ্যে তিনি তৈরি করতে পারেন আকর্ষণীয় ডিজাইনের শর্ট ড্রেস৷
ছবি: Jule Waibel
পানির পাম্পের পাইপ থেকে ব্যাগ
ওয়াটার হোজ বা পানির পাম্পের পাইপ দিয়ে এমন সুদৃশ্য ব্যাগ তৈরি করেন ডিজাইনার ক্যার্স্টিন ক্লোকভ এবং কাই রুডাট৷ দেখেই বোঝা যায় এই ব্যাগ কতটা শক্তপোক্ত৷
ছবি: kayos arts & design
কাঠের ব্যাগ
ওপরের ছবির ব্যাগটি কিন্তু পুরোপুরি কাঠের তৈরি৷ এমন ব্যাগের কারিগর নরব্যার্ট ওটল৷
ছবি: www.focus-fotodesign/A. Ritter
দুধের পোশাক!
ত্বকের জন্য দুধ সবসময়ই ভালো৷ বিজ্ঞানী ও ডিজাইনার আঙ্কে ডোমাস্কে দুধ থেকেই তৈরি করেছেন ফাইবার৷ সেই ফাইবার দিয়ে তৈরি হয় কাপড়৷ এমন অভিনব কাজের জন্য পুরস্কৃতও হয়েছেন ডোমাস্কে৷
ছবি: Jannes Frubel
5 ছবি1 | 5
মাক্স ক্যুনে বললেন, ‘‘আমি বসে বসে কাচের মধ্যে দিয়ে দেখছি, বেশ ভালোই কাজ হচ্ছে৷ কিন্তু শেষমেষ হয়তো কাগজের উপর সেটা ভালো দেখাবে না৷ আমাকে হয়তো কাগজটা বদলাতে হবে... কিন্তু কীভাবে? নতুন কাগজটাই বা কীরকম দেখাবে, তার উপর ছাপার হরফই বা কেমন দেখাবে...’’
প্রতিযোগীরাও আছেন
কাগজ দিয়ে যে কতো কিছু করা সম্ভব, অন্যান্য কোম্পানিও তা আবিষ্কার করেছে৷ বার্লিনের ডিজাইনার ক্যাথরিন গ্রিগুল জাপানি ওয়াশি কাগজ দিয়ে ল্যাম্প তৈরি করেন৷ ক্লাউডিয়া ডিল কাগজ দিয়ে তৈরি করেন ফ্যাশন জুয়েলারি৷ কাগজ মুড়ে, তা ল্যাকার করে তৈরি হয় ঝোলানো কানের দুল বা গলার নেকলেস৷ পেপারলুক্সের পণ্যগুলোও খদ্দেরদের চমকে দেবে, এই হল আশা ও উদ্দেশ্য৷
মাক্স ক্যুনে বললেন, ‘‘ভবিষ্যতেও ছাপার জিনিস থাকবে বলে আমার ধারণা, চিরকাল এভাবেই চলবে৷ তবে তফাতটা ক্রমেই আরো বাড়বে৷ একদিকে থাকবে সস্তার বিজ্ঞাপন, যা লেটারবক্স থেকেই আমি ফেলে দিই; অন্যদিকে এই ধরনের জিনিস, যা দেখলে মনে হয়, দারুণ! আমি এগুলোকে রাখব...’’
হামবুর্গ আলস্টারের রেস্টুরেন্টের মালিক তাঁর নতুন মেন্যুকার্ড দেখে খুব খুশি৷ ক্যুনে-রা ইতিমধ্যেই একাধিক ডিজাইন প্রাইজ পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরো পাবেন, কেননা কাগজের সব সম্ভাবনা শেষ হয়েছে বলে তারা মনে করেন না৷