কাজীদা এবং সেবা প্রকাশনী
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯১৯৬৪ থেকে ২০১৯-এর জানুয়ারি পর্যন্ত সেবা প্রকাশনীর মোট বইয়ের সংখ্যা ২,৪৪৭! এই বইগুলোর মাঝে লুকিয়ে বাঙালির কয়েক প্রজন্মের পাঠক হবার আত্মকথা৷ সেই আত্মকথায় আছে, এক দুঃসাহসী স্পাইয়ের আশ্চর্য মায়াবী জগতের হাতছানি, কিংবা কাউবয় হ্যাট পরা বুনো ফুলের সুবাসিনী সুন্দরীর জন্য হাহাকার৷ আছে ঘরে বসেই বেরিয়ে আসা আমাজনের জঙ্গলের নরমুন্ডু শিকারীদের গ্রাম৷ রহস্য, রোমাঞ্চ আর পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নেয়ার বাঙালি পাঠকের অনন্য এক জাদুকাঠিরই তো অপর নাম এই সেবা প্রকাশনী!
১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু৷ তারও আগে ১৯৬৩-র মে মাসে বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের দেয়া ১০ হাজার টাকায় সেগুনবাগিচায় প্রেস বসানো৷ আট হাজার টাকায় কেনা হলো একটা ট্রেডল মেশিন৷ বাকি দুই হাজারে টাইপরাইটার৷ তারও এক বছর পর ১৯৬৪-র জুনে আত্মপ্রকাশ করলো সেবা প্রকাশনী, ‘কুয়াশা' সিরিজের প্রথম বইয়ের মধ্য দিয়ে৷ প্রকাশিত হলেন একজন থ্রিলার লেখক –কাজী আনোয়ার হোসেন৷ সেগুনের ‘সে' আর বাগিচার ‘বা' নিয়ে যে ‘সেবা' গঠিত হলো, তাতেই যাত্রা শুরু হলো এই ব-দ্বীপে থ্রিলার সাহিত্যের এক অনুপম জগতের৷
১৯৬৬ তে স্পাই থ্রিলার ‘মাসুদ রানা' সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংসপাহাড়' বের হবার পর কিছুটা সমালোচনা হলেও পরের বই ‘ভরতনাট্যম' ছেলে-বুড়ো সবাইকেই নড়েচড়ে বসালো৷
‘‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই৷ গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে৷ বিচিত্র তাঁর জীবন৷ অদ্ভুত রহস্যময় তাঁর গতিবিধি৷ কোমল কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গ এক অন্তর৷ একা, টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না…'' কল্পনার দুর্দান্ত, রোমহর্ষক আর রোমাঞ্চকর এক আনোয়ার হোসেন যেন ধরা দিলেন মাসুদ রানা নামে৷
কেউ যেন পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিয়েছে: কাজী আনোয়ার হোসেন
‘‘১৯৬১ সালে যখন এমএ-র শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে কার্জন হল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটছি, তখন এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল মনের ভেতর৷ প্রথম, আর পড়তে হবে না৷ লেখাপড়ার হাত থেকে বাঁচলাম৷ দ্বিতীয়, এবার? এখন তো গান গেয়ে বেড়ালে চলবে না, জীবিকার জন্য কী করব?
চাকরি করব না, সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনেক আগেই৷ দশটা-পাঁচটার নিশ্চিন্ত জীবনকে রীতিমতো ভয় পাই৷ বাঁধা নিয়মে চলতে হবে সেখানে৷ পারব না৷
স্বপ্ন নয়, ঝোঁকের বসেই জীবিকা হিসেবে নিয়েছিলাম ছাপাখানার ব্যবসা৷ তখন জানতাম না, দশটা-পাঁচটার ভয়ে আমি বেছে নিয়েছি আটটা-দশটার বেধড়ক খাটুনির কাজ৷ দু'-এক বছরেই হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, আসলে এটা আমার লাইন নয়৷ সৃষ্টিশীল কিছু কাজ না করলে আমার মনটা কাঁদে৷ তাহলে তো ভুল পথে পা বাড়িয়েছি৷ ফিরে যে আসবো সে উপায় নেই৷ সবাইকে মুখ দেখাবো কী করে? একেবারে বোকা বনে গেলাম৷ তারপর ধীরে ধীরে বুঝলাম, আমার প্রিয় কোনো কাজ যোগ করতে হবে এই ব্যবসার সঙ্গে৷ কী আমার প্রিয়? গান বাজনা আর লেখালেখি৷''
‘‘প্রেসের সঙ্গে গান-বাজনা অচল৷ তাই গান ছেড়ে দিয়ে লেখা ও প্রকাশনা যোগ করলাম আমার ব্যবসার সঙ্গে৷ প্রতিটাই হোলটাইম জব৷ তাই পরিশ্রম হয়েছে মেলা৷ একা মানুষ, একই সঙ্গে বই লেখা, বই ছাপা, বই প্রকাশ করা এবং সে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ব্রেক ইভেনে পৌঁছতেই আমার আঠারো বছর লেগে গেল৷''
‘‘স্বপ্ন নিয়ে শুরু করিনি৷ তবে কাজ করতে গিয়ে আবছাভাবে হলেও আমি বুঝে গেলাম, আমি ঠিক কী চাই এবং সেই পথেই চলেছি৷ এখন মনে হয়, হ্যাঁ পূরণ হয়েছে আমার স্বপ্ন৷ কেউ যেন আমার হাত ধরে পথ দেখিয়ে এখানে এনে পৌঁছে দিয়েছে৷''
কোথায় থাকে প্রাণভোমরা?
আজও বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী থ্রিলার নায়ক মাসুদ রানা৷ এখন পর্যন্ত এই সিরিজের ৪৫৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ একই রকম জনপ্রিয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর৷
শুধু মাসুদ রানা সিরিজই তো নয়, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিকে একটা ‘স্মার্ট প্রজন্ম' গড়ে দিয়েছে সেবা৷ আজও দিচ্ছে৷ বিনোদনের ভার্সেটাইল আবেদন ছাপিয়ে আজো সেবা তারুণ্যের প্রতীক৷ তাই তো অমর একুশে বইমেলায় সেবার স্টলে ভিড়টা থাকে ধারাবাহিক৷
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কারিকুলাম স্পেশালিস্ট লুতফর রহমান চন্দন ১৩ বছর বয়সে ছোট মামার কাছ থেকে পাওয়া ‘কুয়াশা' সিরিজে প্রথম বুঁদ হয়েছিলেন৷ তারপর ৪০ বছরে টানা ২৪৭ টি মাসুদ রানা পড়েছেন৷ রিলের বাটনটা এখন মেয়ে রুদাবা ফারহিন অনিন্দিতার কাছে৷ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনিন্দিতার মাসুদ রানা নয়, তিন গোয়েন্দা সবচেয়ে প্রিয়৷
সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে চাকরিতে যোগ দেয়া ফার্মাসিস্ট তানিয়া ইদ্রিসের এই ‘তিন গোয়েন্দা'তে হাতে খড়ি হয় ১৯৯৮ সালে৷ রকিব হাসান তিন গোয়েন্দা লেখা ছেড়ে দেবার পর আর ঐ সিরিজ না পড়া হলেও তানিয়া ওয়েস্টার্ন আর অনুবাদের পাঁড় ভক্ত৷ কারণ, ওয়েস্টার্নের সহজ অনুবাদ আর মিস্ট্রি থ্রিল৷ তবে তানিয়া বলছেন, সেবাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে মাথায় রাখতে হবে নতুন সময়ের চাহিদাকে৷ এই প্রসঙ্গে তানিয়া জানালেন, তাঁর ছোট ভাই আবদুল্লাহ আল আজোয়াদ এখন আর সেবা পড়েন না৷ তবে তানিয়া এটাও বলছেন, সেবার অনুবাদ এখনো সেরা৷
কেন ‘সেবা'র অনুবাদ এত জনপ্রিয়? প্রশ্নটা ছিল দীর্ঘ সময় পর আবারও গেল জানুয়ারিতে ‘সাবাডিয়ার' সিরিজ দিয়ে পাঠকের কাছে ফেরা ওয়েস্টার্নের জনপ্রিয় লেখক রওশন জামিলের কাছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানতাম আমাদের পাঠক কারা৷ আমরা চেষ্টা করেছি যথাসম্ভব পাঠকের সাক্ষরতার মাপে লেখাগুলো অনুবাদ করতে৷ আমরা এটাও মাথায় রেখেছি, কথাগুলো আমরা বাংলায় যেভাবে বলবো, সেভাবে লিখবো, সরাসরি অনুবাদ না করে৷ যদিও আমার লেখায় কিছুটা শক্ত বাক্য, শব্দ থাকতো৷''
এই প্রসঙ্গে আরেক ওয়েস্টার্ন লেখক শওকত হোসেন পুরো কৃতিত্বটা দিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেনকে৷ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়ে আর্থার হেইলির ‘রানওয়ে জিরো এইট' অনুবাদের মধ্য দিয়ে সেবার লেখক হয়ে ওঠা শওকত হোসেন বলছেন, ‘‘কাজী দা' কখনো বলে দিতেন না, কোনটা ঠিক করতে হবে৷ তিনি শুধু লেখায় মার্ক করে দিতেন, এগুলো ঠিক হচ্ছে না৷ একজন নতুন লেখক তাতেই মগজ খেলায়৷ এবং ঠিক করে নেয়, কিভাবে লিখলে সাবলীল হবে৷''
শওকত হোসেন কৃতিত্বটা সম্পাদনা পরিষদকেও দিয়েছেন৷ তাঁর মতে, অসাধারণ একটা সম্পাদনা পরিষদই সেবা'র অনুবাদের চরিত্রটা বদলে দিয়েছে৷ তাঁর সময়ে সেবার সম্পাদনা বিভাগে ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান, নাজমুল শফিক, মাহবুব হোসেনসহ আরো অনেকে৷
তবে এখন আর সেবার সম্পাদনা পরিষদ বলে তেমন কিছু নেই৷ কিশোরোপযোগী রহস্যোপন্যাস লিখে সেবার সাথে যুক্ত হওয়া ইসমাইল আরমান মাসুদ রানা সিরিজের শেষ এডিশন ‘অন্তর্যামী'-তে রকাজী আনোযার হোসেনের সহযোগী ছিলেন৷ তিনি বলছেন, ‘‘সম্পাদনার কাজটা সাধারণত সেবার প্রতিষ্ঠিত লেখকরাই করে থাকেন৷ অতীতে এর জন্যে আলাদা এডিটরস প্যানেল ছিল, এখন আর নেই৷ এখন চুক্তিভিত্তিকভাবে সম্পাদনা করা হয়৷''
সেবার প্রায় ষাটটি বইয়ের এই লেখক সেবার তুমুল জনপ্রিয়তার চাপ কীভাবে সামলাচ্ছেন? ইসমাইল আরমান বললেন, ‘‘একটা প্রেশার তো কাজ করেই৷ এমন দীর্ঘ একটা সিরিজে আগের বইগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, কিংবা তার মান ধরে রাখা খুব সহজ নয়৷ তাছাড়া ‘রানা'র পাঠকরাও খুব সচেতন, কোথাও গড়বড় হলেই ধরে ফেলেন৷ তবে কাজটা যেহেতু কাজীদা'র সঙ্গে মিলে করি, খুব একটা সমস্যা হয় না৷ আমি আমার মতো একটা খসড়া দাঁড় করিয়ে দিই, ওটা তিনি নিজের মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে নেন৷ পাঠকের হাতে শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে তাঁর লেখাটাই৷''
তবে জনপ্রিয় লেখক রওশন জামিল সেবা'র জনপ্রিয়তার প্রধান কৃতিত্ব দিয়েছেন টিমওয়ার্ককে৷ প্রায় ২৪ বছর আগের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলাম৷ সবাই৷ শুধু ওয়েস্টার্ন না, মাসুদ রানাই হোক, তিন গোয়েন্দা হোক, কিশোর ক্লাসিক হোক– পুরো বিষয়টাই ছিল পাঠকমুখী৷ বাঙালি পাঠক কী পছন্দ করবে? যেহেতু আমরা নিজেরাও পাঠক ছিলাম৷ ঐ বয়সটা পার হয়ে এসেছি৷ আমরা কী পছন্দ করতাম? ওরা কী পছন্দ করে? আলোচনা বিভাগ থেকেও পাওয়া যেতো নানা চাহিদা৷ সেটাই ছিল আমাদের মূল রেসিপি৷ আমরা চেয়েছি এমন কিছু নিয়ে আসতে যে, পাঠক মজা পাবে, সে নিজেকে ওখানে দেখবে৷ এবং আমরা নায়ককে অতিমানব বানানোর চেষ্টা করিনি, কারণ, অতিমানব হলে পাঠক রিলেট করতে পারবে না৷''
‘‘এর সঙ্গে বাঙালি পাঠকের ভেতরে যে লুকোচুরি খেলা করে তা-ও ভেঙে দিতে চেয়েছে সেবা৷ এজন্য প্রচ্ছদ কিংবা লেখায় একটা অগ্রসর ভাবনাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে৷ বই নির্বাচনেও পাঠকের পছন্দ বিবেচনায় রাখা হয়েছে,'' বলছেন সেবা'র সুবর্ণ সময়ের সাক্ষী রওশন জামিল ও শওকত হোসেন৷
আর ইসমাইল আরমান বর্তমান প্রাযুক্তিক সময়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে লিখছেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বইয়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কমছে, কারণ, তাঁদের সামনে বিনোদনের হাজারো মাধ্যম রয়েছে৷ পাইরেসিও একটা বড় সমস্যা৷ বই প্রকাশ হতে না হতেই তা স্ক্যান করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে৷ এসব কারণে প্রকাশনা শিল্পে চলছে মন্দা৷ সার্বিকভাবে বইয়ের আর সেই জনপ্রিয়তা নেই৷''
তবু এখনো বাংলাদেশের নবীন পাঠকের পাঠক হবার ভেতরের গল্পটা সেবা-কে ঘিরে৷ আর পুরোনো, যেমন লুতফর রহমান চন্দনের কাছে, সেবা'র বই মানে পুরো পৃথিবীটা৷ ক্রিটিক্যালি দেখার চোখটা সেবাই খুলে দিয়েছে এই সরকারি কর্মকর্তার৷ তাঁর বিশ্বাস, গোয়েন্দা পাঠক-শ্রেণি সবসময় থাকবে৷ তাই সেবা-ও থাকবে৷
সেবা প্রকাশনীর ম্যানেজার মমিনুল ইসলাম দাবি করলেন,‘‘পাঠকের কাছে সেবা'র বইয়ের চাহিদা কমেনি৷ এখনো প্রতিমাসে ২৫ হাজার কপির মতো বের হয় রহস্যপত্রিকা৷ মাসুদ রানা'র জনপ্রিয়তাও সমান রয়েছে৷''
তবে মানসম্মত বই প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের বইয়ের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে জানালেন প্রায় ২৪ বছর ধরে সেবা প্রকাশনীতে কর্মরত এই কর্মকর্তা৷
আর তানিয়া ইদ্রিসের মতো পাঠকদের মধ্যে অনেকেই সেবার জন্য কৈশোরে রিক্সায় চড়েনি, টিফিন খায়নি, বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছে, বাজার থেকে টাকা মেরেছে৷ আরো কত কত অপরাধ করেছে শুধু সেবার জন্য৷ সব টাকা বাঁচিয়ে শুধু সেবার বই কিনতেন এই পাঠকেরা৷ এখনো কেনেন নবীন পাঠক৷ আর নির্জন রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে কাল্পনিক হোলস্টারে হাত বুলায় আচমকা শত্রুর প্রতীক্ষায়৷
সেবা প্রকাশনীর কোন সিরিজগুলো আপনার ভালো লাগে? লিখুন নীচের ঘরে৷