'কাতারগেট' প্রকাশ করছে ইউরোপিয়ান সংসদে দুর্নীতির বাস্তবতা
২৬ আগস্ট ২০২৩‘১৯৯২ সালে লন্ডনের এক কাবাবের দোকানে প্রথম কাজ৷ তারপর দেশে বিদেশের নানা অভিজাত পাড়া ঘুরে দুর্নীতির অভিযোগে যুক্ত হয় তুর্কি ব্যবসায়ী হাকান কামুজের নাম৷ সম্প্রতি,ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যদের ঘুস নেবার আলোচনাতেও জড়িয়েছে তার নাম৷
কাবাব শপ থেকে ‘কাতারগেট', লম্বা পথ, কিন্তু তার মাঝে হাকান রণবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করেন৷ তুর্কি ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব নিয়ে পরামর্শও দিতেন তিনি৷ এক পর্যায়ে, পড়াশোনা শেষ করে তিনি আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন৷
এসময়ে তিনি যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে বেশ কিছু ক্রম্পানি চালু করেন, যেগুলির নাম এই ‘কাতারগেট' দুর্নীতিতে উঠে আসছে৷
কামুজ পরিচালিত একটি সংস্থা, ‘স্টোন হোয়াইট', ভারত, ইসরায়েল, সিরিয়া, সৌদি আরবের মতো তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছে৷
ডয়চে ভেলেকে কামুজ বলেন, ‘‘গত ১০ বছরে অভিবাসন আইন বিষয়ে আমাদের কাজ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছে৷
ইইউ পার্লামেন্ট ও কামুজ
২০২২ সালে ইইউ পার্লামেন্টের বেশ কয়েকজন সদস্য, যেমন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইভা কাইলি ও তার সঙ্গী ফ্রাঞ্চেসকো গিওর্গিকে দুর্নীতি, টাকা আত্মসাৎ করা ও অপরাধচক্রের সাথে যুক্ত থাকার দায়ে ব্রাসেলস থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইইউ সংসদ সদস্যদের নগদ টাকা দেবার পাশাপাশি, বিভিন্ন বিলাসবহুল জায়গায় বেড়ানোর ও থাকার ব্যবস্থা বিনামূল্যে করে দেন কাতার, মরক্কো ও মৌরিতানিয়ার কিছু সরকারি কর্মকর্তারা৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল এতে করে ২০২১ সালে ইইউ'র অন্তর্গত সবক'টি বিমানবন্দরে কাতার এয়ারওয়েজকে ছাড় দেওয়ার পক্ষে ইইউ সংসদদের ভোট টানা৷
২০০৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ইইউ সংসদ সদস্য থাকা আন্তোনিও পানজেরি এই ‘কাতারগেট' চক্রের মাথা বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তাকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে পুলিশের সাথে সহায়তা করছে পানজেরি, খবর দিচ্ছে তার সহায়কদের৷
এই পানজেরির সাথে গিওর্গির ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে যৌথ কোম্পানিও৷ এইসব কোম্পানির মাধ্যমেই ঘুসের অর্থ পাচার করা হতো৷
আরো যা তথ্য
পানজেরি ও গিওর্গির বক্তব্য ও কামুজের সাক্ষাৎকার ছাড়াও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পন্থা কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি পেয়েছে ডয়চে ভেলে৷ ২০১৭ সালে জার্মান সংবাদপত্র ডি জ্যুডডয়চেৎসাইটুং ও আইসিআইজে (ইন্টারন্যাশনাল কনসর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস) বিশ্বের কয়েকটি বড় অফশোর কোম্পানিকে খতিয়ে দেখে৷
সেখানে উঠে আসে একটি নাম, রেডিয়ান্ট প্রপার্টিজ, যা নথিভুক্ত আছে যুক্তরাজ্যের দ্বীপ গার্নসিতে৷ সেই সংস্থার পরিচালনা করে রেডিয়ান্ট ট্রাস্ট৷ প্যারাডাইস পেপার্স বলছে, এই সংস্থার মালিক কাতারের রাজপরিবারের সদস্য খালিদ আল থানি ও তার পুত্র, তুর্কি আল থানি৷ খালিদ একইসঙ্গে কাতার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পরিচালকও৷
রেডিয়ান্ট ট্রাস্ট নামে একই গার্নসি দ্বীপে একটি সংস্থার ট্রাস্টি হাকান কামুজ, কিন্তু এই দুই রেডিয়ান্ট ট্রাস্ট একই সংস্থা কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়৷ যদিও যুক্তরাজ্যের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সেই দেশে আর কোনো সংস্থা নেই এই একই নামে৷ কিন্তু কামুজকে খালিদ আল থানির সাথে ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি তা এড়িয়ে যান৷ কাতারের সরকারও ডয়চে ভেলের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি৷
দুর্নীতির কালো ছায়া ইইউ'র ওপর
কাতারগেট চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের অন্দরে ঢুকে গেছে দুর্নীতি, কালো টাকার লেনদেন ও গোপন ব্যবসায়িক বোঝাপড়া৷ এই ঘটনা সামনে আসার পর, ইইউ পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট রোবের্তা মেটসোলা ১৪-দফা প্যাকেজ ঘোষণা করেন দুর্নীতি মোকাবিলায়৷
কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি ডিরেক্টর নিকোলাস আইয়োসা মেটসোলার পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নন৷ তার মতে, ইইউ পার্লামেন্ট সরাসরি কিছু বলছে না এবং ‘‘ইইউ সংসদ সদস্যরা এত দীর্ঘ সময় ধরে বিচারের বাইরে থেকেছেন যে এখন বদলের কথা কল্পনাও করতে পারছেন না৷''
দুর্নীতিবিরোধী নীতির প্রথম খসড়া জুলাইয়ের বদলে এখন বেরোবে সেপ্টেম্বরে৷ কাতারগেট কাণ্ড সামনে আসার পর কেটে গেছে সাত মাসেরও বেশি সময়৷ কিন্তু এখনও ইইউ সংসদে দুর্নীতিবিরোধী কোনো নতুন নীতি প্রণয়ন করা হয়নি৷
মূল প্রতিবেদন: সেরদার ভারদার
সহযোগিতায়: জ্যাক প্যারক (ডয়চে ভেলে) ও পাওলো বিয়োন্দানি (ল'এসপ্রেসো)