নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারতের মতো অনেক দেশের শ্রমিক কাতারে অসহনীয় পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল এক দীর্ঘ রিপোর্টে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরেছে৷
বিজ্ঞাপন
পারস্য উপসাগরীয় ছোট্ট দেশ কাতার অনেক ক্ষেত্রেই চমক দেখিয়ে চলেছে৷ বিশেষ করে ক্রীড়াক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে দেশটি৷ প্রথমে এশিয়ান গেমসের আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে৷ এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের পালা৷ ২০২২ সালে প্রযুক্তির চমক দেখিয়ে স্মরণীয় এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে বদ্ধপরিকর কাতার৷ অলিম্পিক আয়োজনের স্বপ্নও দেখছে দেশটি৷
এত বড় মহাযজ্ঞ মানেই বিশাল আকারের নির্মাণের কাজ৷ কাতারে অতিথি শ্রমিক ও কর্মীদের সংখ্যা নাগরিকদের চেয়ে বেশি৷ নির্মাণের কাজের জন্য আরও শ্রমিক আনা হয়েছে৷ কিন্তু তাঁদের প্রতি অমানবিক আচরণ আন্তর্জাতিক স্তরে বিশাল সমালোচনার ঝড় তুলেছে৷ এবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল ১৬৯ পাতার এক রিপোর্টে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে৷ তাতে বলা হয়েছে, কাতারে বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে জন্তু-জানোয়ারের মতো আচরণ করা হচ্ছে৷ শ্রমিকরা ঠিকমতো মজুরি পাচ্ছেন না, তাঁদের কঠিন ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও অত্যন্ত কঠিন৷ তাছাড়া বিদেশি শ্রমিকরা ইচ্ছামতো দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন না৷ তাঁদের বিশেষ ‘এক্সিট পারমিট'-এর দরকার হয়৷ স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিলেও উপযুক্ত চিকিৎসা পান না তাঁরা৷ অ্যামনেস্টির প্রধান সলিল শেট্টি বলেন, তাঁর টিম গত শুক্রবারই নেপাল ও শ্রীলঙ্কা সহ কিছু দেশের ৭০ জন শ্রমিকের সঙ্গে দেখা করেছে, যাঁরা গত ৯ থেকে ১০ মাস মজুরি পাননি৷
অ্যামনেস্টির মতে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সামগ্রিকভাবেই শ্রমিকরা সে দেশে এমন অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন৷ এই পরিস্থিতি বদলাতে অ্যামনেস্টি ফিফার উদ্দেশ্যে কাতারের উপর চাপ সৃষ্টি করার ডাক দিয়েছে৷ তাদের মতে, বিশ্বকাপের সঙ্গে যুক্ত কোনো নির্মাণ প্রকল্পে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে ফিফা যে সেটা মেনে নেবে না – কাতারের শাসকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে৷
গত ৯ই নভেম্বর দোহায় কাতারের এমির ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর ফিফার প্রধান সেপ ব্লাটার বলেছেন, শ্রমিকদের সমস্যার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ কাতারি কর্তৃপক্ষও অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে৷ এমনকি তারা এক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে গিয়ে বিদেশি শ্রমিকদের অবস্থা খতিয়ে দেখছে৷ অ্যামনেস্টির রিপোর্টকেও এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে বলে দাবি করেছে কাতারের কর্তৃপক্ষ৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
কাতারের নির্মাণ শিল্পক্ষেত্র নিয়ে বহুদিন ধরেই সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ প্রচলিত আইন তারা কৌশলে পাশ কাটিয়ে চলে৷ সাব-কনট্র্যাক্টর কোম্পানিকে দিয়ে শ্রমিক আনিয়ে অনেকেই নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়৷ তাছাড়া ‘কাফালা' নামের যে স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার আওতায় বিদেশি শ্রমিকদের কোনো অধিকার প্রায় নেই বললেই চলে৷ স্পন্সরের অনুমতি ছাড়া অন্য সংস্থায় কাজ করা বা দেশ ছাড়তে পারেন না তাঁরা৷ এই সময়কালে তাঁদের কাছে পাসপোর্টও থাকে না৷ এছাড়া, স্থানীয় লেবার কোর্টের দ্বারস্থ হতে গেলে যে অর্থ জমা দিতে হয়, তা দেবার মতো সামর্থ্যও শ্রমিকদের থাকে না৷