হ্যাকিং করে ভুয়া প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে কাতার সংকট শুরু করা হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে – এমন বিস্ফোরক অভিযোগ করলেন তদন্তকারীরা৷ এদিকে সন্ত্রাস দমনে আইন পরিবর্তন করলো কাতার৷
বিজ্ঞাপন
সৌদি আরব সহ কয়েকটি দেশ কেন আচমকা কাতারের বিরুদ্ধে একঝাঁক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিল, তার মূল কারণ নিয়ে এতকাল অনেক জল্পনাকল্পনা চলছিল৷ কাতারের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল, সে দেশের আমির শেখ তামিম বিন হামেদ আল তানি ইরান, ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন৷ সরকারি কাতার নিউজ এজেন্সির ওয়েবসাইটে সেই সব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল৷ কিন্তু কাতার দাবি করে, আমির কখনোই এমন সব মন্তব্য করে নি – ওয়েবসাইট হ্যাক করে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল৷
গত কয়েক দিন ধরেই সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই হ্যাকিং-এর জন্য দায়ী করা হচ্ছিল৷ বৃহস্পতিবার কাতারের তদন্তকারী গোষ্ঠীর প্রধান জনারেল আলি মহম্মদ আল-মোহানাদি এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই অভিযোগ করলেন৷ তিনি বলেন, আমিরাতের দু'টি সাইট থেকে এই হ্যাকিং পরিচালনা করা হয়েছিল৷ হ্যাকাররা সংবাদ সংস্থার নেটওয়ার্ক দ্রুত কবজা করে সব অ্যাকাউন্ট চুরি করে নেয় এবং ভুয়া খবর আপলোড করে দেয়৷ কাতারের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের উপ প্রধান সাংবাদিকদের আরও বলেন, একজন হ্যাকার এজেন্সির নেটওয়ার্কে একটি ত্রুটি শনাক্ত করে স্কাইপের মাধ্যমে আরেক ব্যক্তিকে সেই খবর জানিয়েছিল৷ সেই ব্যক্তি এই সুযোগে নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয়৷ উল্লেখ্য, জুন মাসেই কাতারের অ্যাটর্নি জেনারেল এই সাইবার হামলার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলিকে সন্দেহ করছিলেন৷
কাতারে হ্যাকিং-এর পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত জড়িত, মার্কিন গোয়েন্দারাও এমন সন্দেহ করছেন বলে দাবি করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট৷ চলতি মাসের শুরুতে এক প্রতিবেদনে এই বিস্ফোরক দাবি তোলা হয়েছিল৷
আমিরাতের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী আনওয়ার গারগাশ অবশ্য এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আসছেন৷ কয়েকদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন৷
এদিকে সন্ত্রাসবাদে মদতের অভিযোগে কিছুটা কোণঠাসা কাতার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে৷ এক রাজকীয় ডিক্রি জারি করে সে দেশের সন্ত্রাস-দমন আইনে রদবদলের ঘোষণা করা হয়েছে৷ ফলে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন পর্যন্ত বিষয়ে অবস্থান আরও স্পষ্ট করা হলো৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাস দমন চুক্তি স্বাক্ষরের এক সপ্তাহের মধ্যেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো৷ ওয়াশিংটনের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কাতারের রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলির দফতরে কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তাকে মোতায়েন করা হবে৷
নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে কতটা প্রস্তুত কাতার?
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের উপর প্রবল চাপ বজায় রাখছে৷ সে দেশ তাদের শর্ত পূরণ না করায় উত্তেজনা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য পদক্ষেপের মুখে সে দেশ কতকাল মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে?
ছবি: Getty Images/ANOC/M. Runnacles
একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টা
জুন মাসের শুরুতেই কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরিবহণ যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল সৌদি আরব, বাহরিন, সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ সন্ত্রাসবাদে মদত সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে কাতারের বিরুদ্ধে৷ কাতার অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Jaafar
শর্ত মানতে অস্বীকার
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের কাছে ১৩টি শর্ত পেশ করেছিল৷ আল জাজিরা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া, ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা কমানো সহ একাধিক দাবি পেশ করা হয়েছে৷ কিন্তু কাতার অনেক অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছে, বাকিগুলির ক্ষেত্রে নতি স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/T.Brakemeier
নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা
সৌদি আরবের সঙ্গে স্থলপথে পরিবহণ যোগাযোগ ছিন্ন হবার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে টান পড়েছে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে কাতার দ্রুত সমুদ্রপথে পণ্য সরবরাহের নতুন ব্যবস্থা করে ফেলে৷ ফলে অভাব-অনটন দেখা যায়নি৷ তবে আমদানি সংক্রান্ত ব্যয় অবশ্যই বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/shalome05
আর্থিক ও অর্থনৈতিক প্রস্তুতি
আচমকা নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় কিছু রদবদল করতে হয়েছে কাতারকে৷ স্থানীয় ব্যাংকে কোটি কোটি ডলার জমা দিয়ে এবং এলএনজি গ্যাসের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে ছোট্ট অথচ বিত্তশালী এই দেশটি৷ অতএব অদূর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞার ফলে তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই৷
ছবি: imago/Photoshot/Construction Photography
নতুন নিষেধাজ্ঞার কালো ছায়া
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের উপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছে৷ এর আওতায় ব্যাংকিং সম্পর্ক ছিন্ন করা হতে পারে৷ তাছাড়া যে সব কোম্পানি কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে এই জোট৷ কাতার সেই ধাক্কা সামলানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডাব্লিউটিও কাতারের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে৷
ছবি: Imago/H. Sobik
নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য পরিণতি
বিপুল অংকের অর্থ ও সম্পদের ফলে কাতার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ গ্যাস ও অন্যান্য পণ্য বিক্রির পথে বাধা না এলে কিছু ধাক্কা সত্ত্বেও কাতারের অর্থনীতিও চালু থাকবে বলে তাঁদের ধারণা৷ সে দেশের সরকার এখন থেকেই নানা পদক্ষেপের কথা ভাবছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Munoz Alvarez
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঝুঁকি
বর্তমান সংকটের ফলে কাতারের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ কারণ ব্যাংকগুলি অর্থের জন্য বিদেশের উপর বড় নির্ভরশীল৷ গত মে মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির প্রায় ৩৬ শতাংশ লায়াবিলিটি ছিল বিদেশিদের হাতে৷ সেই অর্থে টান পড়লে কাতারকে নানাভাবে ঘাটতি পূরণ করতে হবে৷ বিশেষ করে বিদেশে কাতারের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করতে হতে পারে৷