কাতার বিশ্বকাপ: ছাগল-ভেড়ার মাংস যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে
পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৯ নভেম্বর ২০২২
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছাগল ও ভেড়ার মাংস আমদানি করছে কাতার৷ ফিফা বিশ্বকাপের দৌলতে বড় বাজারের দুয়ার খুলে গেল "হরিণঘাটা মিট”-এর সামনে৷
ভারতের অন্য স্থান, পাটনা বা পাঞ্জাবের তুলনায় স্বাদে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঁঠার মাংস।ছবি: Payel Samanta/DW
বিজ্ঞাপন
রোববার থেকে শুরু হচ্ছে "গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ”। আগামী চার সপ্তাহ সারা পৃথিবীর মিলনকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যের কাতার। তাই সব ধরনের খাবারের আয়োজন করতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। পশুর মাংসের ক্ষেত্রে তারা বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কালো ছাগলের মাংসকে। পাঁঠার সঙ্গে ভেড়ার মাংসও রপ্তানি শুরু হয়েছে আরব মুলুকে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দপ্তরের অধীন "ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড”। তাদের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড "হরিণঘাটা মিট”। রাজ্যের সর্বত্র তাদের আউটলেট রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখির মাংস বছরভর বিক্রি করে এই সংস্থাটি। এই "হরিণঘাটা মিট”-এর বেঙ্গল গোট ও ল্যাম্বের মাংস অর্থাৎ পাঁঠা ও ভেড়ার মাংস কাতার রওনা দিয়েছে।
ভারতের অন্য স্থান, পাটনা বা পাঞ্জাবের তুলনায় স্বাদে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঁঠার মাংস। এ মাসের গোড়া থেকেই মাংস রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দপ্তর সূত্রে খবর, বিশ্বকাপের জন্য প্রথম পর্যায়ে এক দশমিক দুই মেট্রিক টন পাঁঠার মাংস পাঠানো হয়৷ এক মাসে ছয় দফায় সাত টন মাংস রপ্তানি করা হবে। প্রাথমিক প্রক্রিয়া এখানে সম্পন্ন করে পশুর দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“বাংলার মাংসও বিশ্বের দরবারে, এটা তো ভাল খবর”
This browser does not support the audio element.
রাজ্যে সংস্থার তিনটি উৎপাদন কেন্দ্রে তাই এখন ব্যস্ততা। উচ্ছ্বসিত প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানিয়েছেন, "বছর দুয়েক ধরে কথা চলছিল। আমাদের মাংস প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে। এখন কাতারে যাচ্ছে, এরপর সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ-সহ বিভিন্ন দেশে বাংলার মাংস যাবে।”
দপ্তর সূত্রে খবর, প্রতি বছর ১০ হাজার মেট্রিক টন মাংস বিদেশে সরবরাহ করা হবে। এতে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। ফিফা বিশ্বকাপের দৌলতে বিশ্বের আরো বড় বাজারের রাস্তা "হরিণঘাটা মিট”-এর সামনে খুলে যাবে বলে আশায় আছেন সংস্থার কর্তারা। এ রাজ্যের একটি পণ্যের এত ভাল বিজ্ঞাপন আর কোনো উপায়ে সম্ভব ছিল না বলেই মনে করছেন তারা।
হরিণঘাটা মিট”-এর বেঙ্গল গোট ও ল্যাম্বের মাংস অর্থাৎ পাঁঠা ও ভেড়ার মাংস কাতার রওনা দিয়েছেছবি: Payel Samanta/DW
বাঙালির রসনায় পাঁঠার কদরই আলাদা। প্রবাদেই আছে, "দধির অগ্র, ঘোলের শেষ, কচি পাঁঠা, বৃদ্ধ মেষ”। এই প্রবাদের মাহাত্ম্য এ বার পাঁঠা-মেষের সূত্রে উপভোগ করবে বিশ্ববাসী। এতে খুশি "ফুডকা” খ্যাত ফুডব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি। এই ফুড ব্লগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাংলার কোনো একটি পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, এটাই খুব ভাল লক্ষণ। বাঙালি ব্যবসায় উন্নতি করছে। ফুটবলেও করবে, আমাদের প্রতিভা আছে।”
রসনা সংক্রান্ত লেখায় পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বিষয়টিকে শ্লেষের দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের ফুটবলের ঐতিহ্য ছিল, সেটা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেছে। কোথায় আর ফুটবল খেলা হয়? তাই এখন ছাগলের মাংস বিশ্বকাপে যাবে, ফুটবলাররা খাবে, এটা শুনে বলতেই হচ্ছে, আহা!”
"সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল”— জনপ্রিয় গানের এই লাইন এখন বাঙালির কাছে বিড়ম্বনার হয়ে উঠলেও পরম্পরা হারিয়ে যায়নি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের নামে এখনো গ্যালারি ভরে যায়। ওপার বাংলায় একই ঐতিহ্য আবাহনী-মহামেডানের। কিন্তু বাঙালির বিশ্বকাপ খেলা হয় না!
“ছাগলের মাংস বিশ্বকাপে,এটা শুনে বলতে হচ্ছে, আহা''
This browser does not support the audio element.
যদিও আশা ছাড়তে রাজি নন ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাংলার মিষ্টির পর মাংসও বিশ্বের দরবারে যাচ্ছে, এটা তো ভাল খবর। ফুটবলও যাবে। ভারত অনূর্ধ্ব ১৭ পুরুষ ও মহিলা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলেছে। সিনিয়রদের বিশ্বকাপেও ভবিষ্যতে আমরা খেলব।”
বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে আরো একটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। কলকাতার দক্ষিণে বেহালার সংস্থা বিএমসি ইলেকট্রোপ্লাস-এর তৈরি ৩০ হাজার ট্রান্সফরমার বসেছে কাতারের স্টেডিয়ামে। সংস্থার দাবি, বিশ্বকাপের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ ট্রান্সফরমারই তাদের তৈরি। এতে ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। এগুলির সাহায্যে আলোকিত হবে বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ।
রসনার তৃপ্তিতে মাঠের বাইরে কারিগর বাঙালি। কিন্তু কবে তাদের ফুটবল পায়ে দেখা যাবে বিশ্বের ময়দানে? এই প্রশ্ন রেখে শেষ হবে আরো একটি বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা কার, কতখানি?
খেলাধুলার তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা স্ট্যাটস পারফর্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিশ্বকাপে কোন দলের জেতার সম্ভাবনা কতখানি তা জানিয়েছে৷ ভবিষ্যদ্বাণী করতে বাজির দর ও দলগুলোর অতীত ও বর্তমান পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিয়েছে৷
এটি খেলাধুলার তথ্য বিশ্লেষণকারী একটি সংস্থা৷ স্প্যানিশ ফুটবল লিগ লা লিগা, প্রচারমাধ্যম ইএসপিএন, সংবাদ সংস্থা রয়টার্সসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যম খেলার পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ তুলে ধরতে স্ট্যাটস পারফর্মের তথ্য ব্যবহার করে৷
বিশ্বকাপ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কয়েকটি বেটিং কোম্পানির বাজির দর ও স্ট্যাটস পারফর্মের নিজস্ব টিম ব়্যাংকিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে কাতার বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা কার কতখানি, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে৷ এছাড়া প্রতি ম্যাচের সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনা করে কে, কোন স্থান অর্জন করে নকআউট পর্যায়ে যেতে পারে এবং সেখানে কে, কার বিরুদ্ধে খেলতে পারে সেই সব বিবেচনা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে৷
পাঁচবারের (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ ও ২০০২) বিশ্ব সেরা ব্রাজিল এবার ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপ জিততে যাচ্ছে বলে স্ট্যাটস পারফর্মের ভবিষ্যদ্বাণী বলছে৷ ফিফা ব়্যাংকিংয়েও এক নম্বরে আছে নেইমাররা৷ স্ট্যাটস পারফর্ম বলছে, সেলেসাওদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা ১৫.৮ শতাংশ৷
ছবি: Isabella Bonotto/AFP
এরপরেই আছে আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনার সমর্থক ছাড়াও এবার আরও অনেকে ফুটবলের বিস্ময় মেসির হাতে শিরোপা দেখতে চাইছেন৷ ভবিষ্যদ্বাণী বলছে তাদের সেই সম্ভাবনা ১২.৬ শতাংশ, সে হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনার তালিকায় ব্রাজিলের পরেই আছে দুবারের (১৯৭৮ ও ১৯৮৬) জয়ী আর্জেন্টিনা৷ ফিফা ব়্যাংকিংয়ে দলটি আছে তিন নম্বরে৷ এছাড়া টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত আছে আলবিসেলেস্তেরা৷
ছবি: Odd Andersen/AFP
তিনে ফ্রান্স
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সে এবারও তারকার অভাব নেই৷ এমবাপ্পে ছাড়াও আছেন সদ্য ব্যালন ডি আর জয়ী বেনজেমা৷ লিওনেল মেসিও ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের ফেভারিট বলেছেন৷ তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, ফিফা ব়্যাংকিংয়ে চার নম্বরে থাকা ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা ১২.২ শতাংশ৷ ১৯৯৮ সালেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফ্রান্স৷
ছবি: Bertrand Guay/AFP
স্পেন চারে
২০১০ সালে একবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন৷ স্ট্যাটস পারফর্ম বলছে, এবার তাদের সেরা হওয়ার সম্ভাবনা ৯.১ শতাংশ৷ কারণ কোচ লুইস এনরিকে ও অধিনায়ক সার্জিও বুসকেটসের দলে আছে গাভি, তোরেস, মোরাতা, কারভাহালের মতো ফুটবলার৷
ছবি: Paul White/AP Photo/picture alliance
পাঁচে ইংল্যান্ড
১৯৬৬ সালের পর থেকে ‘ফুটবলের ঘরে ফেরার’ অপেক্ষায় আছেন ইংলিশ সমর্থকরা৷ গত ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছিল থ্রি লায়নসরা৷ এবার দলে আছেন হ্যারি কেন, রহিম স্টারলিং, ফিল ফোডেনের মতো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বড় দলে খেলা সব ফুটবলার৷ তাই আবারও আশায় বুক বাঁধছেন সমর্থকরা৷
ছবি: Martin Rickett/PA Wire/picture alliance
জার্মানি ছয়ে
ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার (১৯৫৪, ১৯৭৪, ১৯৯০ ও ২০১৪) বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি৷ তবে এবার ফেভারিটের তালিকায় নেই হানসি ফ্লিকের দল৷ গত বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড পেরোতে পারেনি জার্মানি৷ ইউরো ২০২০-এ শেষ ষোলোতে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে গিয়েছিল ‘ডি মানশাফট’৷ ফিফা ব়্যাংকিংয়েও দশের মধ্যে নেই জার্মানি৷
ছবি: Markus Ulmer/ULMER/IMAGO
সাতে নেদারল্যান্ডস
১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ২০১০ সালে ফাইনালে উঠেছিল নেদারল্যান্ডস৷ তবে একবারও কাপ হাতে নিতে পারেনি৷ এবার কি সেই স্বপ্ন পূরণ হবে লুই ফান খালের দলের?
ছবি: Olaf Kraak/AFP
পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক
স্ট্যাটস পারফর্মের ভবিষ্যদ্বাণীর তালিকায় আট, নয় ও দশ নম্বরে আছে পর্তুগাল, বেলজিয়াম ও ডেনমার্ক৷ তারা একবারও বিশ্বকাপ জিততে পারেনি৷ রাশিয়া বিশ্বকাপে ‘গোল্ডেন জেনারেশন’ নিয়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠতে পেরেছিল বেলজিয়াম৷ তবে তাদের সামর্থ্য ক্রমশ কমে যাওয়ায় ফিফা ব়্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন এবারও অধরা থেকে যেতে পারে ক্যাভিন ডি ব্রোইনেদের৷