বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পুষ্টির অভাবে মাটির উর্বরতা কমে চলেছে৷ অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলে যে কাদা সৃষ্টি হচ্ছে, তা কাজে লাগালে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব৷ এক ভূবিজ্ঞানী সেই স্বপ্নই দেখছেন৷
বিজ্ঞাপন
গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণে গেলে বোঝা যায়, ভাইকিংরা কেন একসময়ে এটিকে সবুজ দ্বীপ বলতো৷ চারিদিকে টিলা, মাঠ, হ্রদ ও নদী৷ উত্তরে গেলে তবেই অনন্ত বরফের রাশি দেখা যায়৷ মিনিক রোসিং-এর কাছে এই নিসর্গই হলো স্বভূমি৷ তাঁর জন্ম গ্রিনল্যান্ডে৷ তাঁর পূর্বপুরুষরা সেখানেই শিকার করতেন৷ ডেনমার্কের এই ভূবিজ্ঞানী তাই প্রায়ই সেখানে চলে যান৷ তাঁর মতে, গ্রিনল্যান্ড এক খোলা বইয়ের মতো, যা শুধু পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে৷ মিনিক রোসিং বলেন, ‘‘প্রকৃতির বুকে প্রত্যেকটি পাথর নিজের কাহিনি শোনায়৷ অবশ্যই তাদের ভাষা বুঝতে হবে৷ তখন আর কোনো রহস্য থাকবে না৷ তারা আসলে নিজেদের কাহিনি শোনাতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে৷’’
গ্রিনল্যান্ডে পাওয়া এক পাথর পরীক্ষা করেই রোসিং প্রমাণ করেন যে, পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে৷ সেই আবিষ্কারের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছেন৷ এখন তিনি পাথরের বদলে কাদা সংগ্রহ করছেন৷ কারণ তিনি এক নতুন কাহিনির পেছনে ধাওয়া করছেন৷ অনেকে মনে করছেন, এর মধ্যে বিশাল প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে রয়েছে৷
যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা
প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রেখেছে নাসা৷ পরে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে এখন আকাশ থেকে সেই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে তারা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
অপারেশন আইসব্রিজ
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ক্রিয়োস্ফিয়ার কর্মসূচির অন্তর্গত ‘অপারেশন আইসব্রিজ’-এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে আকাশ থেকে মেরু অঞ্চলের উপর নজর রাখা হচ্ছে৷ ১৯৬৬ সালের লকহিড পি-৩ বিমান থেকে রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যেমে ঐ অঞ্চলের বরফের পুরুত্ব ও স্থান পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রস্তুতি চলছে
অপারেশন আইসব্রিজের মেয়াদ ছয় বছর৷ এর আওতায় মার্চ থেকে মে-তে গ্রিনল্যান্ডে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে অ্যান্টার্কটিকায় আট ঘণ্টা করে কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে বরফের পাত ও খণ্ডের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিমানে আছে উচ্চ প্রযুক্তি
উপর থেকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ক্যানাডার এলেসমেয়ার দ্বীপের গ্লেসিয়ার দেখতে পাচ্ছেন৷ অপারেশন আইসব্রিজে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ ‘আইস-পেনিট্রেটিং রাডার’ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিমান নীচু দিয়ে উড়ে গেলে রাডারটি ভালো কাজ করে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রভাব এখনই দেখা যাচ্ছে
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখনই দেখতে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷ উপরের ছবিতেও সেটি বোঝা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিকল্প ব্যবস্থা
অপারেশন আইসব্রিজ আসলে নাসার একটি বিকল্প ব্যবস্থা৷ কারণ ২০০৩ সালে একই কাজের জন্য ‘আইসস্যাট’ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ চালু করেছিল তারা৷ কিন্তু ২০০৯ সালে সেটি হঠাৎ করে তথ্য সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেয়৷ ফলে ‘আইসস্যাট-দুই’ নামে আরেকটি উপগ্রহ তৈরির কাজ শুরু করেছে নাসা, যেটি আগামী বছর চালু হওয়ার কথা৷ ২০০৯ থেকে ২০১৮ – এই নয় বছরের তথ্যও যেন সংগ্রহে থাকে সেজন্য অপারেশন আইসব্রিজ শুরু করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
সীমাবদ্ধতা
আইসস্যাট-এর মাধ্যমে সারা বছর ধরে অনেক বিস্তৃত এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল৷ কিন্তু অপারেশন আইসব্রিজের সাহায্যে শুধু মেরু অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে এবং সেটিও মাত্র কয়েক মাসের জন্য৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
‘আইসস্যাট-দুই’ নিয়ে অনিশ্চয়তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাসার আর্থ সায়েন্স প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় আগামী বছর এই কৃত্রিম উপগ্রহের কাজ শুরুর বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়েছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
7 ছবি1 | 7
একটি অংশে জমির উপরের বরফ গলে বিশাল পাথর ও নুড়িপাথরের স্তূপ বেরিয়ে পড়েছে৷ তবে পাথরের মরুভূমির মতো দেখতে হলেও এ হলো ধাতব পুষ্টির প্রায় অনন্ত এক ভাণ্ডার৷ রোসিং বলেন, ‘‘হিমবাহের এই কাদা আসলে বরফের চাপে পিষ্ট পাথর৷ বিশ্বের যে সব প্রান্তে মাটিতে পুষ্টির অভাব রয়েছে, এই পুষ্টিকর কাদা সেখানে পাঠানো সম্ভব৷ বিশেষ করে সবচেয়ে জনবহুল ক্রান্তীয় অঞ্চলের মাটিতে পুষ্টির বড়ই অভাব৷’’
এই সূক্ষ্ম ছিদ্রভরা কাদাই বরফ গলা পানি সঙ্গে নিয়ে চলে৷ সেই পানি ঝরে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী সৃষ্টি হয়৷ সেই প্রক্রিয়ার ফলে শেষে নতুন এক এলাকা সৃষ্টি হয়৷ রোসিং-এর মতে, বছরে প্রায় ১০০ কোটি টন কাদা এভাবে গ্রিনল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছে যায়৷ সেই কাদার পুষ্টি গোটা বিশ্বের জন্য খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে৷
গ্রিনল্যান্ডে ফেরার পথে রোসিং এক পুরানো পরিচিত ব্যক্তির দেখা পেলেন৷ মর্টেন নিলসেন গ্রিনহাউসে নানা হার্বস বা জড়িবুটি ও লেটুস পাতা উৎপাদন করেন৷ গ্রিনল্যান্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাতেনাতে টের পাওয়া যাচ্ছে৷ দেশের দক্ষিণে এখন স্ট্রবেরি ও আলু গজাচ্ছে৷ তবে ভবিষ্যতেও সেখানে বড় আকারে চাষবাস সম্ভব হবে না৷ রোসিং বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন এক কঠিন বাস্তব এবং সেই ঘটনাকে বাস্তবসম্মতভাবে দেখতে হবে৷ তার ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে৷ গ্রিনল্যান্ডসহ সারা বিশ্বে আমরা প্রকৃতির অংশ৷ তাতে পরিবর্তন এলে আমাদের যতটা সম্ভব মানিয়ে নিতে হবে৷’’
ঠিক সেই লক্ষ্যেই তিনি কাজ করছেন৷ রোসিং নিজের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী ও বাস্তববাদী৷ তাঁর মতে, স্বনির্ভর হতে চাইলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন৷ মিনিক রোসিং বলেন, ‘‘সমাজ হিসেবে আমরা কীসের উপর নির্ভর করবো? গ্রিনল্যান্ডের অক্ষুণ্ণ ও অনন্ত প্রকৃতি রয়েছে৷ সুমুদ্রে বিশাল পরিমাণ মাছ আছে৷ এ সবের মূল্য বেড়েই চলেছে৷ অন্যদিকে পেট্রোলিয়ামে হাত দেওয়া উচিত নয়৷ আমার পেছনে যে ধূসর কাদা রয়েছে, তার আর্থিক মূল্য বিশাল৷ একদিন আমরা এ থেকে অনেক আয় করবো৷’’
গভীর সমুদ্রে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বপ্ন দেখার বদলে হাতের নাগালেই বিশাল পরিমাণে যে সম্পদ রয়েছে, তা কাজে লাগালেই চলবে৷
মার্ক-ক্রিস্টফ ভাগনার/এসবি
বিশ্বের সবচেয়ে সবুজ সাত শহর
নিজেদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন শহর৷ চলুন এখন অবধি সফল কয়েকটি শহরের কথা জেনে নেয়া যাক৷
ছবি: picture alliance/GES/M. Gilliar
কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক
২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম কার্বন-নিরপেক্ষ শহর হতে চায় কোপেনহেগেন৷ ১৯৯৫ সাল থেকে এখন অবধি শহরটি কার্বন নির্গমণের হার অর্ধেকে কমিয়ে এনেছে৷ শহরের একটি বড় অংশকে গাড়িমুক্ত করে এবং উচ্চমানে গণপরিবহন এবং সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা লেন গড়ে ক্রমশ সবুজ শহরে পরিণত হচ্ছে ডেনমার্কের এই রাজধানী৷
ছবি: DW/E. Kheny
রেকইয়াভিক, আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডের রাজধানীতে তাপ এবং বিদ্যুতের পর্যাপ্ত নবায়নযোগ্য সাপ্লাই রয়েছে৷ মূলত হাইড্রোপাওয়ার এবং জিওথার্মাল থেকে আসে এগুলো৷ শহরটির ৯৫ শতাংশ বাড়ির হিটিং সিস্টেম সরাসরি জেলা হিটিং নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত, যা এক চমৎকার ব্যাপার৷ ২০৪০ সাল নাগাদ শহরের সকল গণপরিবহণ জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত করতে হয় নগর কর্তৃপক্ষ৷ সেখানে সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/U. Bernhart
কুরিটিবা, ব্রাজিল
ব্রাজিলের অস্টম বড় শহর কুরিটিবার ৬০ শতাংশ মানুষ শহরের বাস নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল৷ শহরটিতে আড়াইশ’ কিলোমিটার সাইকেল লেন রয়েছে৷ পাশাপাশি হাঁটার জন্যও আছে বিশেষ ব্যবস্থা৷ শহরটির প্রাকৃতিক সবুজ দেয়াল বন্যা রোধে সহায়তা করে৷
ছবি: picture alliance/GES/M. Gilliar
সান ফ্রান্সিসকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সান ফ্রান্সিসকো শহরে ২০১৬ সালে এক আইন পাস করা হয় যাতে নতুন সব ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়৷ শহরটিতে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ সেই ২০০৭ সাল থেকে৷ ২০২০ সাল নাগাদ নিজেদের আর্বজনামুক্ত শহর ঘোষণার পরিকল্পনা করছে সান ফ্রান্সিসকো৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Edelson
ফ্রাংকফুর্ট, জার্মানি
২০৫০ সাল নাগাদ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর শহরে পরিণত হতে কাজ শুরু করেছে ফ্রাংকফুর্ট৷ নতুন তৈরি হওয়া ভবনগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী করতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে৷ পিভিসির মতো বিতর্কিত সামগ্রী নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ শহরটি আবর্জনার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এক কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করে৷
ছবি: CC BY Epizentrum 3.0
ভ্যানকুভার, কানাডা
২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে সবুজ শহরে পরিণত হতে চায় ফ্রাংকফুর্ট৷ ২০০৭ সালের তুলনায় সেসময় কার্বন নির্গমণের মাত্রা ৩৩ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় শহরটি৷ শহরটির প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের প্রায় সবটাই আসে হাইড্রোইলেক্ট্রনিক ড্যাম থেকে৷ তবে হিটিং এবং গণপরিবহণে এখনো গ্যাস এবং তেল ব্যবহার করে শহরটি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com/A. Chin
কিগালি, রুয়ান্ডা
কিগালিকে বলা হয় আফ্রিকার সবচেয়ে পরিষ্কার শহর৷ এটি পথচারী এবং সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা লেন করার পরিকল্পনা করেছে৷ সেখানে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ আর নগরের বাসিন্দারা মাসে একদিন নগর পরিষ্কারের কাজ করেন৷ তবে নগর পরিষ্কার রাখতে গিয়ে নগরের বাসিন্দাদের উপর বাড়াবাড়িরকম চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন৷
ছবি: Imago/robertharding
লিবিয়ানা, স্লোভেনিয়া
ইউরোপের সবুজ রাজধানী ২০১৬ খেতাবজয়ী এই শহরে বিদ্যুতের উৎস হাইড্রোপাওয়ার৷ গণপরিবহণ, পথচারীদের এবং সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা লেনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে শহরটি৷ ইউরোপের প্রথম শজর হিসেবে আবর্জনার মাত্রা শূণ্যতে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে শহরটি, ইতোমধ্যে আবর্জনার ৬০ শতাংশ রিসাইকেল করতে সক্ষম হয়েছে শহরটি৷