জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে৷ তবে ফাঁসির রায় কবে কার্যকর করা যাবে তা নিয়ে আছে বিতর্ক৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে সোমবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করছে জামায়াত৷
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল রবিবার বিকেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে৷ এরপর তা বিকেলেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেয়া হয়৷ নিয়ম অনুযায়ী রাতেই কনডেম সেলে কাদের মোল্লাকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়৷ এখন তার ফাঁসি কখন কার্যকর হবে তা নিয়ে রাষ্ট্র এবং আসামি পক্ষের মধ্যে শুরু হয়েছে বিতর্ক৷
কাদের মোল্লার আইনজীবী তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী ফাঁসির পরোয়ানা জারির পর ২১ দিনের আগে এবং ২৮ দিনের পরে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না৷ আর রিভিউ পিটিশনের সুযোগ পেলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড স্থগিত থাকবে৷ তিনি আরো জানান, কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য ৭ দিন সময় পাবেন৷ এই সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করে কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর করা হলে সেটা হত্যাকাণ্ডেরই শামিল হবে বলে জানান তাজুল ইসলাম৷
তবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন কাদের মোল্লা রিভিউয়ের কোনো সুযোগ পাবেন না৷ কারণ মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে এই সুযোগ নেই৷ এই সুযোগ সাধারণ দণ্ড বিধির জন্য প্রযোজ্য৷ ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করার যে বিধান আছে তাও ট্রাইব্যুনাল আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ আর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে হয় কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে৷ কিন্তু তিনি যদি প্রাণভিক্ষা না চান তাহলে সাতদিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না৷ কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে এর আগে তার পরিবারের সদস্যরা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে সোমবার কাদের মোল্লার কাছে তা জানতে চাওয়া হবে৷ তিনি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার আবেদন কারা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন৷
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ই ফেব্রুয়ারি প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ এরপর এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এবং আসামি উভয়পক্ষ আপিল করে৷ গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়৷ সেই ৯৭০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ৫ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়৷
ফেব্রুয়ারিতে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ৷ তাদের আন্দোলনের মুখেই আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ দেয়া হয়৷ এর আগে শুধুমাত্র আসামিপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিল৷
গণজাগরণ মঞ্চ কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর রবিবার রাতে শাহবাগে আলোর মিছিল করেছে৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আরো স্বার্থকতার দিকে এগিয়ে যাবে৷ স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ৷
জামায়াতে ইসলামী বলেছে সরকার পরিকল্পিতভাবে বিচারের নামে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালাতে যাচ্ছে৷ এর প্রতিবাদে সোমবার হরতাল ডেকেছে দলটি৷