আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মানবতা বিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে৷ তারা বলেছে, তাঁর ফাঁসির রায়ে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মঙ্গলবার কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন৷ তার আগে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন৷ নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়েছে৷ সংগঠনের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বিবৃতিতে বলেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সব সময় ১৯৭১ সালে সংঘটিত বর্বরতার বিচার চেয়ে আসছে৷ কিন্তু এই বিচার ন্যায়সঙ্গত এবং আইন অনুযায়ী হওয়া উচিত৷
তিনি বলেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে কোনো পরিস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ড বিরোধী৷ কারণ মৃত্যুদণ্ড নিষ্ঠুর এবং অমানবিক৷ তিনি বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটির মতে যে সব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, সে সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা জরুরি৷ তাই অস্বচ্ছ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে তা ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন৷ তিনি মৃত্যুদণ্ডকে বর্বর শাস্তি অভিহিত করে তা থেকে সরে আসার আহ্বান জানান৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
এর জবাবে ড. শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, সাধারণভাবে তিনি নিজেও শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী৷ কিন্তু মানবতা বিরোধী অপরাধের মত জঘন্য অপরাধে যারা জড়িত, তারা মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে পারেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘এটি এক বা দুইজনকে হত্যার বিষয় নয়৷ একাত্তরে বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছেন৷ একটি জাতিকে নির্মূল করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাই এটি সাধারণ কোনো ঘটনা বা হত্যাকাণ্ড নয়৷ এটি মানবতা বিরোধী অপরাধ৷ এই অপরাধে যারা জড়িত তাদের মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য বলে মনে করেন তিনি৷''
তিনি জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো পুরোপুরি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত হয়নি৷ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এখন আর নেই৷ তিনি চান, বাংলাদেশেও মানবতা বিরোধী অপরাধের মত জঘন্য অপরাধ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান শিথিল হোক৷
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাকে অমূলক বলে অভিহিত করেন ড. শাহদীন মালিক৷ তিনি বলেন, অনেকে এটাকে সাধারণ ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলায় এমন ভাবনা তাদের মাথায় আসছে৷ তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনে নিজেরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম হচ্ছে৷ এটা কোনো কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি৷ তাই তারা সুনির্দিষ্ট কোনো কথা না বলে অযৌক্তিক বিরোধিতায় নেমেছে৷