যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি বুধবারও কার্যকর হচ্ছে না৷ কারণ তার রিভিউ আবেদনের শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতুবি করেছেন আপিল বিভাগ৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার ঘণ্টা দেড়েক আগে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয়৷ রাত সাড়ে ১০টার দিকে রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার আদেশ স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছিলেন৷
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড রাতেই কার্যকর হওয়ার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু৷ তিনি তখন মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা বলেছিলেন৷ কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
মঙ্গলবার দুপুরের পর আইন মন্ত্রণালয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে৷ আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাইতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তার ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাধা নেই৷ সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে৷
কাদের মোল্লার স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যাসহ পরিবারের ১১ জন সদস্য মঙ্গলবার রাতে কারাগারে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেছেন৷ তারা কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে রাত ৮টার দিকে কারাগারে যান৷ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলি জানিয়েছেন, কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই তার পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়েছে৷ আর র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ঢাকাসহ সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে৷
এর আগে মঙ্গলবার সকালে কাদের মোল্লার দুই আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সকালে কারাগারে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন৷ এরপর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, কাদের মোল্লা তার ফাঁসির দণ্ড রিভিউয়ের আবেদন করতে বলেছেন রাষ্ট্রপতির কাছে৷ তবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে কোনো মতামত মঙ্গলবার পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান৷ আর সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলি জানান কাদের মোল্লার কাছে তারা প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট কোনো মতামত দেননি৷
গত ৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায়ের প্রতিবাদে গড়ে ওঠে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ৷ তারা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানায়৷ ট্রাইব্যুনাল আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিল না৷ এরপর আইন সংশোধন করায় রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে৷ আপিলে কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ১৭ সেপ্টেম্বর৷ আর খালাস চেয়ে কাদের মোল্লার করা আপিল অগ্রাহ্য হয়৷
গত ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়৷ তাতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়৷ গত রবিবার ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে৷ বিকেলেই পরোয়ানা হাতে পায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার৷ আর রবিবারই কাদের মোল্লাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এনে কনডেম সেলে রাখা হয়৷
২০১০ সালের ১৩ জুলাই কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়৷ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুটতরাজের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে আদালতে৷ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ কাদের মোল্লাই হলেন বাংলাদেশের প্রথম যুদ্ধাপরাধী যার দণ্ড কার্যকর হতে যাচ্ছে৷