একদিকে উদযাপন, অন্যদিকে ত্রাস। কাবুল সহ গোটা আফগানিস্তানে মিশ্র ছবি। জরুরি আলোচনায় জাতিসংঘ।
বিজ্ঞাপন
বিশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরছেন নির্বাসিত তালেবান নেতারা। তা নিয়ে আফগান জনগণের একাংশ আনন্দিত। মঙ্গলবার কান্দাহারে পা রাখেন শীর্ষ তালেবান নেতা মোল্লাহ আবদুল গনি বারাদার। এতদিন তিনি দোহায় ছিলেন। আফগান প্রশাসনের সঙ্গে তালেবানের যে দীর্ঘ সমঝোতা বৈঠক চলছিল দোহায়, তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। এর আগে অ্যামেরিকার সঙ্গে শান্তি বৈঠকেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তালেবান কাবুল দখলের পর তালেবান-আফগান বৈঠক ভেস্তে গেছে। বিশ বছর পর নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন শীর্ষ তালেবান নেতৃত্ব।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকেলে বারাদার কান্দাহারে পা রাখতেই উল্লাসে ফেটে পড়েন বহু মানুষ। বিশাল কনভয় নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেন।
কাবুলে সাংবাদিক বৈঠক
অন্যদিকে এদিনই কাবুলে প্রথম সাংবাদিক বৈঠক করেন তালেবান মুখপাত্র। সেই সাংবাদিক বৈঠক ঘিরেও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকদের। সাংবাদিক বৈঠকে খানিকটা মধ্যবর্তী অবস্থান নিয়েছেন তালেবান নেতৃত্ব। জানিয়েছেন, বিদেশি শক্তির সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কড়া অবস্থান নেওয়া হবে না। যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদেরও ফিরে আসার আহ্বান করেছেন তালেবান মুখপাত্র। তিনি জানিয়েছেন, সমস্ত আফগানকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আফগানিস্তান তৈরির লক্ষ্যে এগোচ্ছেন তালেবান নেতৃত্ব।
তালেবানের শীর্ষ নেতা কারা?
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশ দখল করে নিয়েছে তালেবান৷ ১৯৯৪ সালে গঠিত তালেবানের বর্তমান শীর্ষ নেতাদের পরিচয় জানা যাবে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Gulabuddin Amiri/AP/picture alliance
হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা
তালেবানের সুপ্রিম নেতা আখুন্দজাদা এই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সর্বোচ্চ ব্যক্তি৷ ২০১৬ সালে তার পূর্বসূরী আখতার মনসুর মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর দায়িত্ব পান আখুন্দজাদা৷ পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুচলাক শহরের এক মসজিদে তিনি প্রায় ১৫ বছর শিক্ষকতা ও ধর্মপ্রচারের কাজ করেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স৷ তার বয়স প্রায় ৬০ বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Imago/Xinhua
মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে তিনি৷ তালেবানের সামরিক অভিযানের দায়িত্বে আছেন ইয়াকুব৷ ২০১৬ সালে আখতার মনসুর নিহত হওয়ার পর ইয়াকুবকে তালেবানের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কম এবং বয়স কম হওয়ায় ইয়াকুব নেতা হিসেবে আখুন্দজাদার নাম প্রস্তাব করেন৷ ইয়াকুবের বয়স ৩০-এর ঘরে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Gulabuddin Amiri/AP/picture alliance
সিরাজুদ্দীন হাক্কানি
হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান৷ পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তালেবানের আর্থিক ও সামরিক সম্পদ দেখাশোনা করে এই গোষ্ঠী৷ আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমা হামলার চল এই গোষ্ঠী শুরু করে বলে মনে করা হয়৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে হত্যার চেষ্টা, ভারতীয় দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দায়ী করা হয়৷ হাক্কানির বয়স ৪০-এর ঘরে শেষ থেকে ৫০-এর ঘরে শুরু পর্যন্ত বলে মনে করা হয়৷
ছবি: FBI/REUTERS
মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার
তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বারাদার এই গোষ্ঠীর রাজনীতি বিভাগের প্রধান৷ কাতারের দোহায় আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে যে আলোচনা চলছিল, সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি৷ তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্ম ছিলেন বারাদার৷ ২০১০ সালে পাকিস্তানের করাচিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ ২০১৮ সালে তিনি ছাড়া পান৷
ছবি: Alexander Zemlianichenko/REUTERS
শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানেকজাই
তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তিনি উপমন্ত্রী ছিলেন৷ এরপর প্রায় এক দশক তিনি কাতারের দোহায় বাস করেন৷ ২০১৫ সালে তাকে দোহার রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান করা হয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যকার আলোচনায় তিনি উপস্থিত ছিলেন৷ এছাড়া বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সফরে তালেবানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন স্তানেকজাই৷
ছবি: Sefa Karacan/AA/picture alliance
আব্দুল হাকিম হাক্কানি
তাকে তালেবানের বর্তমান সুপ্রিম নেতা আখুন্দজাদার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মনে করা হয়৷ তিনি তালেবানের সাবেক ছায়া প্রধান বিচারপতি৷ বর্তমানে তিনি এই গোষ্ঠীর ধর্মীয় পণ্ডিতদের প্রভাবশালী সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন৷ আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয়া তালেবানের প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন হাক্কানি৷ উপরের ছবিটি ২০০৫ সালের৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
6 ছবি1 | 6
এখনো পালাচ্ছে মানুষ
মঙ্গলবারও আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছেন বহু মানুষ। অ্যামেরিকা জানিয়েছে, এদিন এগারোশ মার্কিন নাগরিককে উদ্ধার করে দেশের বিমানে চড়ানো হয়েছে। ১৩টি মার্কিন সেনার বিমান এদিন আফগানিস্তান থেকে অ্যামেরিকায় উড়েছে। হোয়াইট হাউস সূত্র সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে তিন হাজার ২০০ মার্কিন নাগরিককে অ্যামেরিকার বিমানে তোলা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে দুই হাজার আফগানকেও অ্যামেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তবে হোয়াইট হাউসের বক্তব্য, এখনো বহু অ্যামেরিকান আফগানিস্তানে আটকে আছেন। তাদের জন্য একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রশাসন। অ্যামেরিকার সংবাদমাধ্যমে বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব সকলকে কাবুল বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু তারা কী ভাবে পৌঁছাবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কথা বলা হয়নি ওই বিবৃতিতে। নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়েও কোনো কথা বলা হয়নি। মার্কিন কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, এখনো প্রায় ১০ হাজার অ্যামেরিকান নাগরিক আফগানিস্তানে আটকে আছেন।
মঙ্গলবার ১৩০ জন জার্মান নাগরিককে কাবুল থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখনো বেশ কিছু জার্মান নাগরিক আফগানিস্তানে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
কাবুল বিমানবন্দরের ভয়াবহ ছবি
রোববারই কাবুল দখল করেছে তালেবান। শহর ঘিরে রেখেছে তারা। বিমানবন্দরে পালাতে চাওয়া মানুষের ভিড়। বিমানের মাথায় মানুষ। ভিড়ের চাপে মৃত সাত।
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
বিমান না বাস
উপমহাদেশে বাসের মাথায় অনেকসময় মানুষ চড়েন, ট্রেনের মাথাতেও মাঝেমধ্যে দেখা যায় তাদের। কিন্তু তাই বলে বিমানের মাথায় মানুষ! সেই দৃশ্যও দেখা গেল কাবুল বিমানবন্দরে। কাবুল ছাড়ার জন্য কিছু মানুষ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
প্রবল ভিড়
যেদিকে দেখা যায়, সেদিকেই মানুষের মাথা। পিলপিল করছে মানুষ। বিমানবন্দরের ভিতরের ছবি।
ছবি: AFP
কোথায় যাবেন
কোথায় যাবেন জানা নেই। তাদের কাছে টিকিট নেই, ভিসা নেই, আছে শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় এবং পালানোর মরিয়া প্রয়াস।
ছবি: AP Photo/picture alliance
পাঁচিল ও কাঁটাতারের বেড়া টপকে
বিমানবন্দরে উঁচু পাঁচিল, তার উপরে কাঁটাতারের বেড়া। সে সব টপকে মানুষ ঢুকেছেন বিমানবন্দরে। ছবিতে একটি মেয়েকে পাঁচিলে টেনে তুলছেন এক পুরুষ।
ছবি: REUTERS
যে কোনো ভাবে ঢোকার চেষ্টা
বিমানে যে কোনো ভাবে ঢোকার চেষ্টা করেছেন মানুষ। একমাত্র বিমানেই কাবুল তথা আফগানিস্তানের বাইরে যাওয়া যাবে। তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ।
ছবি: AP Photo/picture alliance
বাইরে গাড়ি রেখে
মানুষ এতটাই বেপরোয়া, যে বিমানবন্দরের বাইরে গাড়ি রেখে পরিবারের সকলকে নিয়ে তারা ছুটছেন ভিতরে ঢোকার জন্য।
ছবি: REUTERS
নারী ও শিশুরাও
শুধু পুরুষরা নয়। নারী ও শিশুদেরও দেখা গেছে বিমানবন্দরে ঢুকে প্লেন ধরার মরিয়া চেষ্টা করতে।
ছবি: REUTERS
বাইরে তালেবান প্রহরা
বিমানবন্দরের বাইরে সতর্ক পাহারায় তালেবান। বন্দুক হাতে তারা প্রহরারত।
ছবি: REUTERS
ভিড়ের চাপে
প্রবল ভিড় এবং বিশৃঙ্খলার শিকার হলেন অন্ততপক্ষে সাতজন। পালাতে চেয়েছিলেন তারা। পারলেন না। চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ছবি: AFP/Getty Images
মার্কিন বিমানবাহিনীর বিমান
কাবুল বিমানবন্দরের উপরে মার্কিন বিমানবাহিনীর বিমান। এই বিমানবন্দর এখনো অ্যামেরিকার দখলে।
ছবি: ASVAKA NEWS via REUTERS
বিমান ঘিরে সেনা
পরিস্থিতি দেখে মার্কিন সেনা বিমানগুলি ঘিরে ধরে। আফগান জনতা দূর থেকে দেখছেন। তারা তখনো আশায় যে, বিমানে করে চলে যেতে পারবেন।
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
নামতে পারল না
বিমানবন্দরের এমন অবস্থা ছিল যে, সোমবার জার্মান সেনাবাহিনীর বিমান সেখানে নামতে পর্যন্ত পারেনি।
সকলকে বিমানবন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্ধ রাখা হয় এয়ারপোর্ট। বেশ কয়েকঘণ্টা পরে তা খোলে।
ছবি: Maxar Technologies/REUTERS
13 ছবি1 | 13
শরণার্থী সমস্যা
আফগানিস্তানে অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক অবশ্য এখনো তাদের দূতাবাস খোলা রেখেছে। জাতিসংঘও তাদের বহু দফতর বন্ধ করে দিয়েছে। তবে শরণার্থী নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর আফগানিস্তানে কাজ চালিয়ে যাবে বলে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুইশ কর্মী কাবুল সহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে আছেন বলে জানানো হয়েছে। ডিডাব্লিউকে তারা জানিয়েছে, বহু আফগান শরণার্থীর এখন যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ইরান-পাকিস্তানও তাদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।
অস্ট্রিয়া জানিয়েছে, তাদের দেশে আফগান শরণার্থীদের জায়গা দেওয়া হবে না। তাদের বক্তব্য, দেশটিতে প্রায় ৩৫ হাজার আফগান শরণার্থী আছেন। যাদের অধিকাংশই নবীন। শিক্ষার অভাবে তারা অস্ট্রিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। সে কারণেই নতুন করে শরণার্থী নেওয়া হবে না।
যুক্তরাজ্য অবশ্য জানিয়েছে, তারা ২০ হাজার নতুন আফগান শরণার্থী নিতে প্রস্তুত। যাদের জীবনের ঝুঁকি আছে, তাদেরকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। এদিনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে তারা জি সেভেনের একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন। আগামী সপ্তাহে বৈঠক হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।