কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে কিছুটা সময় লাগবে
হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বেশ কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, যা চলতি মাসে শেষ হওয়া সম্ভব নয়৷ রিভিউ পিটিশন ও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও ২১ দিনের আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায় না৷
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতি মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বুধবার স্বাক্ষর করার পর, তা বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়৷ ট্রাইব্যুনাল বুধবারই কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে৷ মৃত্যু পরোয়ানা এবং পূর্ণাঙ্গ রায় এরইমধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. মোস্তাফিজুর রহমান৷
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানান যে, তারা লাল সালুতে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা এবং রায়ের কপি পেয়েছেন৷ দিনের যে কোনো সময় কামারুজ্জামানকে এই মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হবে৷
ঐ কর্মকর্তা জানান, ‘‘মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিনক্ষণ ঠিক করবে সরকার৷ এটাই আইন৷ তবে সাধারণ নিয়মে আরো কিছু আইনি প্রক্রিয়া বাকি আছে৷''
তিনি জানান, ‘‘ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো ব্যতিক্রম না থাকলে কামারুজ্জামান পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে পরবর্তী ১৫ দিন রিভিউ আবেদন করার সুযোগ পাবেন৷ সাধারণত দণ্ডপ্রাপ্তরা শেষ দিনেই রিভিউ আবেদন করেন৷ এছাড়া রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর যদি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সাতদিন সময় পাবেন৷ রাষ্ট্রপতির কাছে যদি তিনি প্রাণভিক্ষা না পান, তাহলে তা নিষ্পত্তি হওয়ার পর আর প্রাণভিক্ষা না চাইলে সাতদিন শেষ হওয়ার পরই ফাঁসি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়৷''
কর্মকর্তা আরো জানান, ‘‘এক্ষেত্রে কারাবিধি অনুযায়ী সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওযার ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়৷ এর মানে হলো, ২১ দিনের আগে এবং ২৮ দিনের পর মুত্যুদণ্ড আর কার্যকর করা যাবে না৷''
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করায় এখন সরকারের পক্ষে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দিন ধার্য করতে কোনো অসুবিধা নেই৷ তবে কামারুজ্জামানের পক্ষ থেকে রিভিউ পিটিশন করা হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যাবে৷''
ওদিকে কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা রিভিউ পিটিশন করব৷ এরইমধ্যে রিভিউ আবেদনের জন্য রায়ের সার্টিফায়েড কপি চেয়ে আবেদনও করেছি৷ কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আমরা রিভিউ আবেদন করব৷''
তিনি বলেন, ‘‘সার্টিফায়েড কপি পওয়ার পর থেকেই ১৫ দিনের হিসাব হবে৷ আমরা এই ১৫ দিনের মধ্যেই আবেদন করব৷ এর মধ্যে রায় কার্যকর করার কোনো সুযোগ নেই৷''
২০১৩ সালের ৯ই মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আল-বদর বাহিনীর ময়মনসিংহ শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বলেও প্রমাণ হয় রায়ে৷ পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন৷