জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে বুধবার সই করেছেন চার বিচারপতি৷ এর মাধ্যমে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় এখন যে-কোনো সময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
গত ৫ই এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন বাতিল করে আপিল বিভাগ৷
সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. সাব্বির ফয়েজ বুধবার বিকেল ৩টার দিকে ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আপিল বিভাগের চার বিচারপতি রায়ে সই করেছেন৷ সইয়ের পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে তা মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো হয়েছে৷ ট্রাইবুন্যাল থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে৷ কারাগারে পৌঁছালেই দণ্ড কার্যকরের শেষ আনুষ্ঠানিকতা সারতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ৷'' খারিজ আদেশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর কাছেও পাঠানো হয়েছে৷
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ফরমান আলি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার জন্য আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি৷ আদালতের রায়ের কপি এলেই আমরা সব ব্যবস্থা নেব৷ তবে তার আগে তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা তা জানা হবে৷''
বিভিন্ন দেশে যেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য একেক দেশ একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমন কয়েকটি উপায়ের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইনজেকশন
অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সোডিয়াম পেন্টোনাল, সম্পূর্ণ অক্ষম করার জন্য প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড আর হৃদযন্ত্র থামিয়ে দেয়ার জন্য পটাশিয়াম ক্লোরাইড নামের তিনটি রাসায়নিক উপাদান ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনামে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: BilderBox
গুলি
ইন্দোনেশিয়া, চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ এরপর সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একের পর এক গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে
অভিযুক্তকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে তার মাথা ও পায়ের মাধ্যমে শরীরে ৫০০ থেকে ২,০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ প্রতিবার ৩০ সেকেন্ড করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ এই পদ্ধতিটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাঁসি
বাংলাদেশ সহ আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, ইরাক, জাপান, মালয়েশিয়া ও কুয়েতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
শিরশ্ছেদ
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিরশ্ছেদ বিষয়টি রয়েছে৷ তবে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবে এই পদ্ধতিটি চালু রয়েছে৷ সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে শিরশ্ছেদ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
অন্যান্য উপায়
পাথর ছুড়ে মারা, গ্যাস চেম্বারে ফেলে দেয়া, অনেক উঁচু থেকে অভিযুক্তকে নীচে ফেলে দেয়ার মাধ্যমেও কোথাও কোথাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
এর আগে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, ‘‘আমরা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে সার্বিকভাবে প্রস্তুত আছি৷ এখন শুধু রায়ের কপির অপেক্ষা৷''
জানা গেছে, রায়ের চূড়ান্ত কপি তৈরির পর বুধবার সেটিতে সই করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফিরোজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী৷
প্রধান বিচারপতির অনুমোদনক্রমে আপিল বিভাগের কনিষ্ঠ বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী রায়ের খসড়াটি তৈরি করেন৷ ৩৬ পাতার ওই রায়ের কপি তিনি উপস্থাপন করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে৷ বিধি অনুসারে রায়টি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছেও পাঠানো হয়৷
এরপর রায় চূড়ান্ত হলে চার বিচারপতি সই করে বুধবার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের রেজিস্ট্রারের কাছে তা পাঠিয়ে দেন৷
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-২ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের আল-বদর বাহিনীর প্রধান কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ দেন৷ গত বছরের ৩রা নভেম্বর ট্রাইবুন্যালের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকা
২০১৩ সালে মোট ২২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: Fotolia/lafota
চীন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, চীনে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ তবে ব্যাপারটিকে যেহেতু চীনে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় হিসেবে দেখা হয় তাই অ্যামনেস্টির পক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যা জানানো সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইরান
তিনভাবে ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় – গুলি করে, পাথর ছুড়ে আর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে৷ ২০১৩ সালে এভাবে কমপক্ষে ৩৬৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷ সামান্য অভিযোগে সাংবাদিক সহ মানবাধিকার কর্মীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মাঝেমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়ে দেশটি৷
ছবি: ISNA
ইরাক
সাদ্দাম হুসেনের আমলে ইরাকে বেশি সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটতো৷ ২০১৩ সালে ১৬৯ জনের বেশি বন্দিকে এই শাস্তি পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী৷
ছবি: picture alliance/dpa
সৌদি আরব
২০১৩ সালে ১৮ বছরের কম বয়সি তিনজন সহ কমপক্ষে ৭৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি আরব৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
যুক্তরাষ্ট্র
ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এভাবে ২০১৩ সালে ৩৯ জনকে শাস্তি দেয়া হয়৷ অবশ্য সে বছর কমপক্ষে ৮০ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷
ছবি: CHANTAL VALERY/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ ১৮ নম্বরে
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আছে সোমালিয়ার নাম৷ ২০১৩ সালে সেদেশে ৩৪ জনের বেশি বন্দির প্রাণ নেয়া হয়৷ তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে ১৮ নম্বরে৷ অ্যামনেস্টির হিসেবে ঐ বছর বাংলাদেশে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
6 ছবি1 | 6
এরপর গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন৷ ১৯শে ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-২ এর তিন বিচারপতি৷ ট্রাইবুন্যাল থেকে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আইজিপি (প্রিজন), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে৷ কারাগারে কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়৷
এরপর কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হলে আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ ৫ই মার্চ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন৷ এরপর কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন৷
কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর হলে এটি হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ্বিতীয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর৷ এর আগে ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর একই অপরাধে আরেক জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷