আটক সাংবাদিক শফিক রেহমানের মুক্তি দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য কাজ করা ২৬টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের জোট ‘রেপ্রিভ'৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে তারা রেহমানের মুক্তির জন্য আবেদন পাঠিয়েছে ইতিমধ্যেই৷
বিজ্ঞাপন
রেপ্রিভ-এর চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের পর তিন মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি৷
রেপ্রিভ ‘ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ', ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স', ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস' এবং ‘পেন অ্যামেরিকা'সহ ২৬টি সংগঠনের একটি আন্তর্জাতিক জোট৷
তাদের করা আবেদনে বলা হয়েছে, ‘শফিক রেহমানকে আটকের পর এক সপ্তাহ আলাদা সেলে রাখা হয়েছিল৷ সেখানে তাঁকে ঘুমানোর বিছানাও দেয়া হয়নি৷' তারা সাংবাদিক শফিক রেহমানকে মুক্তি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আইনমন্ত্রীর মাধ্যমে আবেদনটি জমা দিয়েছেন৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
রেপ্রিভ-এর চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘শফিক রেহমান একজন পেশাদার সাংবাদিক৷ তিনি তাঁর সারা জীবন বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন৷ তাঁকে আটকের ঘটনা সংবাদমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার প্রতি হুমকি বলে আমরা মনে করি৷'
বলা বাহুল্য, তিনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি৷ তাই তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে রেহমানের পরিবার খুবই উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে৷
ওদিকে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার নাদিম কাদির সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি৷ তাছাড়া শফিক রেহমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যা পরিকল্পনা মামলায় আটক আছেন৷ তাই পুলিশের তদন্ত করতে সময় লাগতে পারে৷ আর সেটাই তো স্বাভাবিক৷''
গত ১৬ই এপ্রিল পুলিশ শফিক রেহমানকে তাঁর ঢাকার ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে৷ পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে যুক্তরাষ্ট্রে অপহরণ ও হত্যা-চেষ্টা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷
জয়নাল আবেদীন মেসবাহ
শফিক রেহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মেসবাহ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই মামলায় পুলিশ এখনো কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দেয়নি৷ অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এখনো আনা হয়নি৷ আর তাই তিনি জামিনও পাচ্ছেন না৷ কারাগারে তিনি দুঃসহ জীবনযাপন করছেন৷ ৮২ বছর বয়সে এই কারাবাস তাঁর জন্য অনেক কষ্টের৷ তিনি নানা রোগে ভুগছেন৷''
তিনি জানান, ‘‘শফিক রেহমানকে জামিন দেয়নি নিম্ন আদালত৷ তারপর হাইকোর্টও তাঁর জামিন আবেদন নাকোচ করে৷ তবে গত ১৭ই জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে একটি চার সদস্যের বেঞ্চ শফিক রেহমানকে উচ্চ আদালতে আপিলের অনুমতি দেয়৷ তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেয়া হয়৷''
বন্ধু, আপনি কী মনে করেন? শফিক রেহমানকে কি ছেড়ে দেওয়া উচিত? লিখুন নীচের ঘরে৷