বাংলাদেশে ব্লগার অভিজিৎ ও অনন্ত হত্যার তিনজন পরিকল্পনকারীকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছে র্যাব৷ এরা হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলি মিঠু এবং মো. আমিনুল মল্লিক৷
বিজ্ঞাপন
র্যাব-এর মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানত তৌহিদুর রহমানই হলেন অভিজিৎ রায় এবং অনন্ত বিজয় দাস – এই দুই ব্লগার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী৷ তিনি কাশিমপুর কারাগারে আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানির নির্দেশেই এ হত্যা পরিকল্পনা করেন৷''
সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার নীলক্ষেত থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সাদেক আলী মিঠুকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩৷ তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে রাত ১২টার পর হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমান ও মো. আমিনুল মল্লিককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ প্রসঙ্গত, মিঠু এই দুই ব্লগার হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন৷
হত্যার হুমকি পাওয়া এক ব্লগার
তাঁর বাবা হুমায়ুন আজাদের ওপরও হামলা হয়েছিল৷ বাবা তাঁর ছেলে অনন্যকে বলেছিলেন, ‘এরপর তুমি...’৷ হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই ব্লগার অনন্য আজাদকে হত্যার হুমকি দিয়েছে জঙ্গিরা৷ তাঁকে নিয়েই আজকের ছবিঘর...
ছবি: DW/Gönna Ketels
লিখে যেতে চান অনন্য
ঢাকায় জন্ম৷ ঢাকা শহরকে তাই খুব ভালোবাসেন অনন্য আজাদ৷ এই শহর ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি, তবে হত্যার হুমকি দেয়ার পর থেকে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল৷ তারপরও লেখলেখি থামাননি৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
চিন্তা মুক্ত, মতামত নয়
২৪ বছর বয়সি ব্লগার অনন্য নিজেকে ‘মুক্তচিন্তক’ মনে করেন৷ তিনি মনে করেন, ধর্ম বা যে কোনো কিছুকে বিশ্বাস করা বা না করার অধিকার সবারই থাকা উচিত৷ এই ভাবনা নিয়েই লেখালেখি করেন৷ এ কারণে ইসলামি জঙ্গিরা তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
আত্মরক্ষার চেষ্টা
২০১৩ সালে ৮৪ জন ব্লগারের নামের তালিকা প্রকাশ করে তাঁদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়৷ পরের ৩ বছরে মোট ৯ জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে৷ হালে দিনের আলোয়, জনাকীর্ণ স্থানে ব্লগার হত্যার ঘটনার পর তাঁকেও হত্যার হুমকি দেয়ায় অনন্য সাবধানে চলাফেরা শুরু করেন৷ ঢাকায় তো হেলমেট না পরে বেরই হতেন না তিনি৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
চিন্তার জগতে এক
ইসলামি জঙ্গি এবং তাদের ভাবধারায় বিশ্বাসীরা ব্লগারদের ঢালাওভাবে ‘নাস্তিক’ বলছে৷ কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের খুব কম ব্লগারই ধর্মের সমালোচনা করে লেখালেখি করেন৷ সরকার শুধু ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থই নয়, উল্টো ব্লগারদের ওপরই বিধিনিষেধ আরোপ করতে সচেষ্ট৷ অনেক ক্ষেত্রে ব্লগারদেই বরং বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
ঐতিহাসিক বিরোধ
একাত্তরে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ৷ যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামিসহ কয়েকটি দল পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, তাদের অনেক কর্মী হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছে৷ ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ব্লগাররা আন্দোলন শুরু করে৷ শাহবাগে সমবেত হয় লাখো মানুষ৷ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা প্রকাশ করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
এরপর তুমি...
বাবা হুমায়ুন আজাদ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং লেখক৷ তাঁর ওপরও হামলা হয়েছিল৷ হুমায়ুন আজাদ তার কিছুদিন পরই মারা যান৷ একদিন হুমায়ুন অনন্যকে বলেছিলেন, ‘‘এরপর তুমি...৷’’ হুমায়ুন তাঁর লেখায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেন৷ তাই হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়৷ অনন্যকেও হত্যার হুমকি দিয়েছে জঙ্গিরা৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
‘গৃহবন্দিত্ব’ থেকে মুক্তি
হত্যার হুমকির পরও লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন অনন্য৷ লিখছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান ধরে রেখে৷ কয়েকদিন হলো বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে এসেছেন অনন্য আজাদ৷ প্রিয় শহর ঢাকায় নিজের বাড়িতেই প্রায় বন্দি থাকার যন্ত্রণা থেকে আপাতত মুক্তি!
ছবি: DW/Gönna Ketels
7 ছবি1 | 7
গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ এরপর গত ১২ই মে সিলেট শহরের সুবিদবাজার এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে৷
র্যাব-এর মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ আবারো বলেন, ‘‘কাশিমপুর কারাগারে থাকা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সংগঠক জসিম উদ্দিন রহমানির নির্দেশেই মূলত হত্যাকাণ্ড হয়েছে৷ জসিম উদ্দিন রহমানির আপন ছোট ভাই আবুল বাশার কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করে তৌহিদুরসহ সংগঠনের অন্য সদস্যদের পরিকল্পনার কথা জানায়৷ আর তারপরই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা করে তৌহিদুর রহমান৷
মুফতি মাহমুদ জানান, ‘‘অভিজিৎ ও অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডে পাঁচজন অংশ নেয়৷ এরা হলেন – রমজান সিয়াম, নাঈম, জুলহাস বিশ্বাস, জাফরান আল হাসান ও সাদেক আলী মিঠু৷ এদের মধ্যে সাদেক র্যাব-এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে৷''
আটক সাদেক আলী মিঠু আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানির বইয়ের প্রকাশক ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা৷ মিঠু প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন৷ মিঠুর সঙ্গে জসিম উদ্দিন রাহমানির পরিচয় হয় ২০০৭ সালে৷ পরে সাদেক আলী রাহমানির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ও আস্থাভাজন হয়ে উঠে৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
র্যাব জানিয়েছে, তৌহিদুর রহমান এক সময় বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করতেন৷ তিনি ১৯৯০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান৷ আইটি বিষয়ে পড়াশোনা শেষে সেদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন৷ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ফেসবুক ও বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হতো৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি বিভিন্ন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে অর্থায়ন করেছেন৷ কাকে কাকে হত্যা করতে হবে, তা তৌহিদ নির্ধারণ করতেন৷ আইটি বিশেষজ্ঞ হওয়ায় তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ব্লগে বিভিন্ন জনের লেখা পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি৷ জসিম উদ্দিন রহমানি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তৌহিদুর ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশে আসেন৷ গ্রেপ্তার অপর আসামি আমিনুল মল্লিকও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একজন সক্রিয় সদস্য ও সংগঠনের যে সকল সদস্য আত্মগোপনে ও পালিয়ে দেশের বাহিরে যেতে চায় তাদেরকে বিভিন্ন নামে পাসপোর্ট তৈরি করে দিত৷
র্যাব-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ব্লগার অভিজিৎ এবং অনন্ত হত্যার বিষয়টি স্পষ্ট হলো৷ জানা গেল কারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত এবং তাদেরও উদ্দেশ্য৷
প্রসঙ্গত, ব্লগার অভিজিৎ হত্যাতাণ্ডের তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)৷ তারা এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷ এছাড়া অনন্ত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে সিআইডি৷ তারাও জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷
গত সাড়ে পাঁচ মাসে বাংলাদেশে চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়৷