বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলে অং সান সুচি এবং মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ আরো বিপন্ন হতে পারে৷ কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি সেরকম কিছু ভাবছে?
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং করোনাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সুচি-কে দু বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে মিয়ানমারের আদালত৷ এ রায়কে সুচি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্রের অংশ বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ক্যানাডা সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ‘অবরোধের' ঘোষণা দিয়েছে৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ক্যানাডার এই ঘোষণার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নও নতুন অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা না দিলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে তার ভুল বার্তা যাবে৷ জান্তা সরকার হয়ত ধরে নেবে, ইইউ সুচি-র মুক্তি এবং মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিষয়কে আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না৷
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট তাই ইইউ-এর প্রতি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর নতুন করে আরো কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন৷ এ বিষয়ে ইইউর সিদ্ধান্ত জানার জন্য ইইউর মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ডয়চে ভেলেকে তিনি কিছু বলতে চাননি৷
সু চি-র বিচার, সরব বিশ্ব
সোমবার মিয়ানমারের রাজধানীতে শুরু হয়েছে অং সান সু চি-র বিচার। মঙ্গলবারও অন্য একটি মামলায় শুনানি হবে তার।
ছবি: Sakchai Lalit/AP Photo/picture alliance
ওয়াকি-টকি কেস
সোমবারের মামলায় জুন্টা সরকার আদালতকে জানিয়েছে, বিদেশ থেকে বেআইনি ভাবে ওয়াকি-টকি এনেছিলেন সু চি। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অতিমারি আইনে মামলা হয়েছে। করোনার সময় তিনি ভোটের প্রচার করেছিলেন।
ছবি: REUTERS
চার মাস পর বিচার
চার মাস আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনা। সু চি-কে গ্রেপ্তার করা হয়। এতদিন পর তার বিচার শুরু হলো।
ছবি: AFP/Getty Images
জুন্টা আদালতে বিচার
সেনা জুন্টার আদালতেই বিচার শুরু হয়েছে সু চির। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দেশের গোপন তথ্য বিদেশে পাচার করার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অর্থ তছরুপ এবং বেআইনি সোনা রাখার অভিযোগও করা হয়েছে।
ছবি: AP/dpa/picture alliance
দেশ জুড়ে বিক্ষোভ
সু চি গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। সু চি-র বিচার শুরু হওয়ার পরেও দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ আনা হয়েছে সু চি-র বিরুদ্ধে।
ছবি: STR/AFP/Getty Images
এনএলডি-র উপর কোপ
সু চি-র দলের নাম এনএলডি। সু চি-র বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়ায়, তার দল আপাতত সরকার চালাতে পারবে না। নির্বাচনেও লড়াই করতে পারবে না।
ছবি: STR/AFP/Getty Images
অভিযোগ অস্বীকার
সু চি-র আইনজীবীরা আদালতে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সু চি-কে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে।
ছবি: STR/AFP/Getty Images
আন্তর্জাতিক চাপ
জাতিসংঘ প্রথম থেকেই সু চি-র মুক্তির দাবি করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সু চি-র বিচার প্রক্রিয়াকে অর্থহীন বলে চিহ্নিত করেছে।
ছবি: Jack Taylor/AFP/Getty Images
বানানো মামলা
আন্তর্জাতিক মহলের বক্তব্য, সু চি-র বিরুদ্ধে প্রতিটি মামলাই সাজানো। তাকে গ্রেপ্তার করার জন্যই অভিযোগ গুলি দায়ের করা হয়েছে।
ছবি: REUTERS
8 ছবি1 | 8
১৯৬২ সাল থেকে সামরিক শাসনের অধীনে থাকা থাকা মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন সুচি৷ ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নোবেলজয়ী এই নেত্রীর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)-ই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল৷ কিন্তু সামরিক বাহিনী সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে সুচিকে গ্রেপ্তার করে ক্ষমতা দখল করে৷ তারপর বেশ কিছু অভিযোগে অনেকগুলো মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে৷ সব মামলায় সাজা হলে সব মিলিয়ে একশ বছরেরও কারাদণ্ড হতে পারে শান্তিতে নোবেল জয়ী সুচির৷
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা বার্মা ক্যাম্পেইন-এর পরিচালক মার্ক ফার্মানার মনে করেন, ইইউর উচিত আবার মিয়ানমারের সেনা শাসক এবং তাদের আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ক্রিয়াশীল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ইইউ সর্বশেষ অবরোধটি যে আরোপ করেছিল তা-ও ছয় মাস হয়ে গেছে৷ আবার কোনো অবরোধের ঘোষণা না দিলে (মিয়ানমারের) সেনাবাহিনী মন করবে ইইউ তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেবে না৷''
নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন পা হারানো এক ‘যোদ্ধা
সন্তান জানতে চেয়েছিল, ‘‘তোমার পা কোথায়?’’ কো ফিও বলেছিলেন, ‘‘কুকুর নিয়ে গেছে৷’’ অনিচ্ছায় হলেও যাদের কুকুর বলেছিলেন মিয়ানমারকে এখনো তাদের হাত থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেন কো ফিও৷ ছবিঘরে তার জীবনের গল্প....
ছবি: REUTERS
এক ছা-পোষার প্রতিবাদী হয়ে ওঠা
ইয়াঙ্গনে রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির যানবাহনের লাইসেন্সিং বিভাগের কর্মী কো ফিও৷ কিন্তু গত দুই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনি অং সান সু চিকে আটক করে ক্ষমতা দখলের পর যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হলে চাকরি, নিরাপদ জীবন ইত্যাদিকে গুরুত্ব না দিয়ে কো ফিও-ও নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়৷
ছবি: REUTERS
সেদিনের কথা
মার্চের সেই দুপুরে সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং সু চি-র মুক্তির দাবিতে চলমান বিক্ষোভে কো ফিও-ও ছিলেন৷ হঠাৎ তার পা লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক সেনাসদস্য৷ পায়ে গুলি লাগায় উপুড় হয়ে পড়ে যান কো ফিও৷ এক পুলিশ সদস্য তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে হয়ত প্রাণ নিয়েই আর ফেরা হতো না৷
ছবি: REUTERS
অনুমতি দিলেন পা কাটার
পায়ে গুলি লাগলেও একেবারে কেটে ফেলতে হবে তা ভাবতেও পারেননি কো ফিও৷ কিন্তু হাসপাতালে যত দিন যাচ্ছিলো ব্যথা তত তীব্র হচ্ছিলো৷ একটা সময় কো ফিও নিজেই ডাক্তারদের বললেন, ‘‘এত ব্যথা সহ্য করা যায় না৷ আপনারা আমার পা কেটে ফেলুন৷’’
ছবি: REUTERS
সন্তানকে প্রবোধ
নিজের কাটা পা সবসময় ঢেকে রাখেন ২৪ বছর বয়সি কো ফিও৷ কিন্তু ঢেকে রাখলেই তো কষ্ট আড়াল হয় না! প্রথম দিন দু বছরের সন্তান জানতে চেয়েছিল, ‘‘বাবা, তোমার পা কোথায়?’’ মা-হারা ছেলেটাকে সত্যি কথা বলতে পারেননি৷ বলেছিলেন, ‘‘আমার এই পা-টা একটা কুকুর নিয়ে গেছে৷ একদিন এসে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবে৷’’
ছবি: REUTERS
সহযোদ্ধাদের প্রতি আস্থা
সেনশাসনবিরোধী চলমান আন্দোলনে এ পর্যন্ত ৮০০ মানুষ মারা গেছেন বলে জানিয়েছে অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স৷ এখনো চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ৷ পা হারানোয় কো ফিও-র বিক্ষোভে যোগ দিতে পারেন না৷ তার গণতন্ত্রকামী সহযোদ্ধারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, একদিন সাফল্য আসবেই- এ আশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘লড়াই চালিয়ে যেতে হবে৷ শহীদদের প্রতি সুবিচারের স্বার্থেও এ লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে৷’’
ছবি: AP/picture alliance
5 ছবি1 | 5
গত ফেব্রুয়ারিতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারের সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে তিনবার অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে ইইউ৷ সর্বশেষ ঘোষণাটি এসেছিল গত জুনে৷ কিন্তু বাইরের দেশগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের অর্থনৈতিক অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় মিয়ানমারের সেনা শাসকদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ সুচি এবং গণতন্ত্রের মুক্তির দাবিতে মিয়ানমারে এখনো চলছে আন্দোলন৷ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের হামলায় এ পর্যন্ত ১৩০০ আন্দোলনকর্মী নিহত হয়েছেন৷
ব্রিটেনভিত্তিক শিক্ষাবিদ ক্রিস্টিনা কিরোনস্কা-ও মনে করেন মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে চাপে রাখতে হলে আবার নতুন অবরোধের ঘোষণা দিতে হবে ইইউকে৷ মিয়ানমারের বিষয়ে ইইউ-র সাম্প্রতিক নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ইইউ আসলে অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি, যদিও ‘‘এক সময় ইইউ বড় কিছু ঘটলে যে বছরে একবার অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিতো- সাম্প্রতিক সময়ে সেই নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসায় মনে হচ্ছিল ইইউ অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে৷''
মিয়ানমার: সেনাশাসন, বন্দুকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও গুলতির প্রতিরোধ
দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার সেনাশাসনে৷ সেনাশাসনবিরোধী বিক্ষোভের ওপর চলছে গুলি৷ গুলির জবাব দেয়া হচ্ছে গুলতিতে৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: REUTERS
প্রতিদিন রাজপথে রক্ত
১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চি-কে আটক করে সেনাবাহিনী৷ এভাবে সেনাশাসন শুরুর পর সু চি-র মুক্তি এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভে নামে জনতা৷বিক্ষোভ মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলা চলতে থাকে নিয়মিত৷ হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮০ জন বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন৷ ছবিতে গুলিতে আহত একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যা্চ্ছেন বিক্ষোভকারীরা৷
ছবি: REUTERS
শেষ শ্রদ্ধা
সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে ১৯ বছর বয়সি তরুণ খান্ত নিয়ার-হাইন৷ অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার সময় তাকে তিন আঙুলে স্যালুট জানাচ্ছেন স্থানীয়রা৷
ছবি: REUTERS
গুলতিই তার হাতিয়ার
সেনাশাসনের দ্রুত অবসান চায় বিক্ষোভকারীরা৷ দাবি আদায়ে মরিয়া তারা৷ প্রতিরোধে তারা মরিয়া৷ তাই এক তরুণ সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ছে গুলতি হাতে৷
ছবি: REUTERS
আহতদের প্রতি সেনাবাহিনীর আচরণ
বিক্ষোভ, আন্দোলনের শুরুর দিকে কিছুটা সহনশীলতা দেখালেও এক সময় আগ্রাসী হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী৷ গুলিতে আহতদের এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া এখন প্রায় নিয়মিত দৃশ্য৷
ছবি: via REUTERS
আরেক আহত
গুলিতে আহত আরেকজনকে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের হাসপাতালের দিকে ছুটে যাওয়ার মুহূর্ত৷
ছবি: REUTERS
গুলতিযোদ্ধা
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুলতি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কয়েকজন তরুণ৷
গত ১৩ মার্চ রাতে সারা দেশে মশাল মিছিল করে বিক্ষোভকারীরা৷ ওপরের ছবিটি সাগাইং অঞ্চলের খিন উ শহরের৷
ছবি: REUTERS
আহত ভিক্ষু
মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এবারও সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়৷ ২০০৭ সালের মতো এবারও বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন দল বেঁধে৷ ছবিতে আহত এক ভিক্ষুকে হাসপাতালে নেয়ার দৃশ্য৷
ছবি: REUTERS
স্বজনের কান্না
গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেয়া অং থান-কে শেষ বিদায় জানানোর সময় স্বজনদের কান্না৷
ছবি: REUTERS
মোমবাতি মিছিল
ইয়াঙ্গনের হ্লেডান জংশন এলাকায় সেনাশাসনের অবসান ও অং সান সু চি-র মুক্তি দাবিতে মোমবাতি মিছিল৷ ১৪ মার্চের ছবি৷
ছবি: REUTERS
11 ছবি1 | 11
বিবৃতিতেই সন্তুষ্ট ইইউ?
গত সপ্তাহের শুরুতে এক বিবৃতিতে ইইউ-র পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক কমিটির প্রধান ইয়োসেপ বোরেল বলেন, ‘‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এই রায়ের তীব্র নিন্দা জানায়৷ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এটি মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি বড় আঘাত৷'' তারপর থেকে সুচি এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রের বিষয়ে উদ্বেগ বা সামরিক শাসকদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে কোনো বিবৃতিও দেয়নি ইইউ৷