বাংলাদেশের সমাজে কার্টুনের প্রভাব অনেক
৪ মে ২০১৫ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় বিভিন্নভাবে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়৷ এ বছর প্রতিযোগিতার বাকস্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড-এর জন্য বিজয়ী নির্ধারণ করেছেন ডয়চে ভেলের পরিচালকমণ্ডলী৷ অন্যদিকে জুরিমণ্ডলী নির্ধারণ করেছেন তিনটি ক্যাটেগরিতে চূড়ান্ত বিজয়ীদের৷ এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভোটের ভিত্তিতে দ্য বব্স-এর ১৪টি ভাষা বিভাগে পিপল'স চয়েস অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের নির্ধারণ করা হয়েছে৷
চলতি বছর বাংলা ভাষায় পিপল'স চয়েস অ্যাওয়ার্ড জয় করেছে নরওয়েতে বসবাসরত কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের ‘টুনস ম্যাগ'৷ কার্টুনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় ম্যাগাজিনটিতে৷
কার্টুন আঁকার দায়ে কারাভোগ
রহমান বাংলাদেশে একটি আলোচিত নাম৷ ২০০৭ সালে দৈনিক প্রথম আলো প্রত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি কার্টুন গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ অভিযোগ ওঠে, কার্টুনটির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে৷ সেসময় কারাভোগ করতে হয় রহমানকে৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমার ঐ কার্টুনটার বেলায় যেটা ঘটেছিল, সেটাকে ‘তিলকে তাল করা' বলা যেতে পারে৷ কেউ কেউ ভুলভাবে কার্টুনটার ব্যাখ্যা করেছিলেন, নিজ নিজ স্বার্থে৷ অসংখ্যবার মৃত্যু হুমকি পেয়েছি, এমনকি জেলের ভিতরেও আমার ওপর বেশ করেকবার আক্রমণ করা হয়েছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবির কিছু সন্ত্রাসী আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জেলখানার ভিতরেই৷ কিছু মুসলিম নামধারী আমার মুখে মানুষের বর্জ্য ছুড়ে মেরেছিল৷ একবার আমাকে মেরে আমার ডানকানে জখম করে দেয়া হয়েছিল, এরপর থেকে আমার ডান কানে সমস্যা৷
সেসময় অবস্থা বেগতিক দেখে পত্রিকার সম্পাদকরাও রহমানের কার্টুন আর প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়েছিল৷ এমনকি ভবিষ্যতে কোনো দিন তাঁর আঁকা কার্টুন না প্রকাশের অঙ্গিকার করেছিল৷ সেসময়কার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রহমান বলেন, ‘‘ছয় মাস দু'দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জেল খেতে বের হওয়ার পরও আমার জীবন ছিল বিপন্ন৷ ২০০৯ সালে যশোরের একটা নিম্ন আদালত ওই একই কার্টুনের জন্য ২ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড করে৷ মাসে মাসে ঢাকা থেকে যশোর গিয়ে মামলার হাজিরা দিতে দিতে, আর উকিলদের বিল দিতে দিতে মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে হিমশিম খেতাম৷ এরকম আরো অনেক অনেক অবিচার আমার সাথে হয়েছিল ওই একটা কার্টুনের জন্য৷
নরওয়েতে বাকস্বাধীনতা
সেই ঘটনার পর বিদেশে পাড়ি জমান আরিফুর রহমান৷ বর্তমানে নরওয়েতে স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি৷ নরওয়ে সরকার তাঁকে সম্মানজনক অবস্থানে রেখেছে৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেকথা জানান তিনি৷ রহমান বলেন, ‘‘নরওয়ে ও সুইডেনে গত চার বছরে প্রায় ২০ বার যৌথ ও এককভাবে আমার কার্টুন প্রদর্শিত হয়েছে৷ ৯ মে সুইডেনে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক কমিক ফেস্টিভাল থেকে আমাকে ‘অফিসিয়াল গেস্ট' হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘টুনস ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ৪৭টি দেশের ১১৫ জন কার্টুনিস্টের কার্টুন নিয়ে, আমি আর এক সিরিয়ান কার্টুনিস্ট মিলে ‘‘যুদ্ধ শিশু'' শিরোনামে একটা আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করতে যাচ্ছি, যেখানে নরওয়েজিয়ান কার্টুন গ্যালারি সহযোগিতা করছে৷ নরয়েতে ড্রয়িং গ্রুপ নামে স্থানীয় আর্টিস্টদের নিয়ে একটা সংগঠন করেছি সেটাতেও নরওয়েজিয়ান কার্টুন গ্যলারি সহযোগিতা করছে৷
দেশে ফেরার উপায় নেই
নরওয়েতে ভালো থাকলেও দেশে আর ফিরতে পারছেন না আরিফুর রহমান৷ তাঁর নামে আদালতে মামলা চলছে৷ তাই ফিরতে চাইলে জটিলতা অনেকে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি দেশে ফিরলে হয়ত যশোরের ঐ মামলার সাথে আদালত অবমাননার মামলা খেতে হবে৷ তাই আপাতত দেশে ফেরার কথা ভাবছি না৷ তাছাড়া নরওয়ে থেকে যে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয়েছে, তাতে লেখা আছে যে আমি একমাত্র বাংলাদেশ ব্যতিত সকল দেশে ভ্রমণ করতে পারব৷''
বাংলাদেশের সমাজে কার্টুনের প্রভাব অনেক, মনে করেন রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, কার্টুন বাংলাদেশের সমাজে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে৷ বিশেষ করে রাজনীতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলে কার্টুন৷ কারণ কার্টুনের ভাষাটা সহজেই সবাই উপলব্ধি করতে পারে৷ এমনকি যারা পড়তে বা লিখতে জানে না, তারাও কার্টুন দেখে বলতে পারে কী এর ভাবার্থ৷''
হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ম্যাগাজিন
টুনস ম্যাগাজিন ডয়চে ভেলের সম্মাননা অর্জন করায় আনন্দিত এবং অনুপ্রাণিত আরিফুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘এটি টুনস ম্যাগাজিন-এর জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি৷ আর এই প্রাপ্তি অর্জনের লক্ষ্যে যে বা যারা টুনস ম্যাগাজিনকে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার পিপল'স চয়েস-এর জন্য মনোনীত করেছিল, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এবং ধন্যবাদ সকল অনলাইন ভোটারদের যাঁরা ভোট দিয়ে বিজয়ী নির্বাচিত হতে সাহায্য করেছেন৷''
ডয়চে ভেলেকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আরো একটি মজার তথ্য জানিয়েছেন আরিফুর রহমান৷ তাঁর ম্যাগাজনটি তিনি চালান নিজের হাত খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকা দিয়ে৷ তিনি বলেন, ‘‘টুনস ম্যাগাজিন-এর কার্যক্রমের পিছনে খরচের অর্থ কোনো দাতা বা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে না৷ যাবতীয় খরচের অর্থ আমার হাত খরচের অর্থ থেকে বাঁচিয়ে তা টুনস ম্যাগাজিন-এর জন্য ব্যয় করি৷''
তিনি বলেন, ‘‘টুনস ম্যাগাজিন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে৷ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কার্টুন ও লেখার মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা৷ শিল্প ও শিল্পীর প্রচার ও প্রসারের মাধ্যম হিসাবে কাজ করা৷''
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে টুনস ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন আরিফুর রহমান৷ বর্তমানে বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি ও স্প্যানিশ ভাষায় ম্যাগাজিনটি নিয়মিত অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে৷ ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি ভাষা সংযোজন এবং ম্যাগাজিনটির একটি প্রিন্ট সংস্করণ প্রকাশের চেষ্টা করছেন রহমান৷