1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

কালো টাকা সাদা : আধারেও ‘আঁধার'?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১২ জুন ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালো টাকা সাদা করার প্রসঙ্গে বলেছেন, "মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না।'' কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন সার্বিক বিচারে অনেক বেশি ক্ষতিই বয়ে আনবে এই কৌশল৷

বাংলাদেশ টাকা
বাংলাদেশে ‘সাদা টাকা'র সর্বোচ্চ কর এখন ৩০ শতাংশ আর কালো টাকার পরিমাণ যা-ই হোক ১৫ শতাংশ কর দিলেই তা ‘সাদা' হয়ে যাবেছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance

বাংলাদেশে কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত (আনট্যাক্সড) আয় নয়। অবৈধ আয়ও বৈধ করার উদ্যোগ নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে - কালো টাকা সাদা করার এমন সুযোগের উদ্দেশ্য কী?

বাংলাদেশে ‘সাদা টাকা'র সর্বোচ্চ কর এখন ৩০ শতাংশ আর কালো টাকার পরিমাণ যা-ই হোক ১৫ শতাংশ কর দিলেই তা ‘সাদা' হয়ে যাবে। এই ‘সুবিধা'র কারণে এখন দেশে কালো টাকা বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

এবার বাজেটে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। আর সেক্ষেত্রে আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। সেই টাকা গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট কেনায় বিনিয়োগ করা যাবে।  ফলে  ঘুস, দুর্নীতি, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে যে-কোনো ‘অবৈধ আয়' শতকরা ১৫ শতাংশ কর দিলে বৈধ হয়ে যাবে।

এবারের বাজেট ঘোষণার পর থেকে কালো টাকার মালিকরা সুবিধা পাচ্ছেন বেশি। ঘোষিত বাজেটে বছরে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত। কিন্তু এরপর আয়করের আরো সাতটি ধাপ আছে। সেই ধাপগুলোতে আয়কর ক্রমে বাড়ে। যেমন তিন লাখ টাকার পরের এক লাখ টাকার আয়কর পাঁচ শতাংশ। এভাবে তৃতীয় ধাপে গিয়ে আয় কর ১৫ শতাংশ আর সপ্তম ধাপে গিয় ৩০ শতাংশ। কিন্তু কালো টাকার জন্য দিতে হবে ১৫ শতাংশ। তাতে আয় যত বেশিই হোক কোনো অসুবিধা নেই।

বাজেটে যেটা করা হয়েছে তা ভয়াবহ: মজিদ

This browser does not support the audio element.

বাজেট পেশের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  ঢাকায় একটি দলীয় অনুষ্ঠানে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের পক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "আমি বলি মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না। সেই রকম একটা ব্যবস্থা, এটা আসলে আগেও হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু করেছিল, আর পরেও প্রত্যেক সরকারই করে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কালো টাকা সাদা করায় অর্থনীতির কোনো লাভ নাই। একটি মহল বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এটা করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআার)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ অব্দুল মজিদ বলেন, " যদি প্রদর্শিত আয় (আনট্যাক্সড মানি) হয়, তাহলে তা করের আওতায় আনা সহজ। রাজস্ব আইনেই তার ব্যবস্থা আছে। সেটা হলো তাকে প্রচলিত হারে (যত বছর) কর দিতে হবে এবং তার ওপরে এনবিআরের ধার্য করা কিছু জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু বাজেটে যেটা করা হয়েছে তা ভয়াবহ।”

তার  মতে," এর মধ্য দিয়ে যারা নিয়মিত কর দেন, তারা বেশি দেবেন আর যারা দেন না তারা কম কর দেবেন তা প্রতিষ্ঠিত হলো। আরো যেটা খারাপ দিক, সেটা হলো, অনুপার্জিত আয় (অবৈধ আয়) বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলো। এটা আইনবিরোধী। দেশে তো তাহলে আর আইন আদালতের দরকার পড়ে না।”

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ১. সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। ২. নতুন করদাতা তৈরি হবে না ৩. অসাম্য তৈরি হবে ৪. অবৈধ আয় করতে মানুষ ভয় পাবে না, উল্টো উৎসাহী হবে ৪. আইন ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে ৫. ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে ৬. এখন যারা নিয়মিত কর দেন, তারাও অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারেন।

তার কথা, "এটা আসলে দুর্নীতিবাজদের সুবিধা দিতেই করা হয়েছে, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে খারাপ মেসেজ দেবে।  আয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবেনা এবং নিয়মিত করদাতাদের চেয়ে কম কর দেয়ার এই নীতি শুধু বাংলাদেশেই আছে।”

আর সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলালউদ্দিন বলেন, "কেউ যদি পাঁচ বছর ট্যাক্স না দিয়ে সেই টাকা ব্যাংকে রাখে তাহলে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাহলে ট্যাক্স নিয়মিত কেন দেবে? বরং পরে দিলে আরো কম ট্যাক্স দিতে হবে তাকে।”

"সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এবার কালো টাকার সংজ্ঞাই বদলে দেয়া হয়েছে। সেখানে আয়ের উৎস নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। ফলে ঘুসের টাকা, চুরির টাকা, ছিনতাইয়ের টাকা, অবৈধ ব্যবসার টাকা সবই হালাল হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

তার কথা, "প্রধানমন্ত্রী আধার দিয়ে মাছ ধরার কথা বলেছেন। এটা হয়তো তিনি একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু অতীতে কখনো তাদের ট্যাক্স নেটে এনে আইনের আওতায় আনতে দেখা যায়নি। আর প্রধানমন্ত্রীর কথা ঠিক হলে কালো টাকার মালিকরা তো ধরা দেবে না। বাস্তবেও এই সুযোগ দিয়ে সামান্য অর্থই নিয়মিত চ্যানেলে আনা গেছে। ফলে এই সুযোগ দিয়ে কোনো লাভ নেই।”

তিনি বলেন, "পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীরের এই যে অবৈধ টাকা এরকম আরো অনেকের টাকা আছে। রাজনীতিবিদদের আছে। তারা যদি এই টাকা দেশে রাখতে চায় এবং সরকার পরিবর্তন হলে তাদের যাতে ধরা না যায়, তাদের সেই দায়মুক্তি দিয়ে রাখা হচ্ছে এই সুবিধা দিয়ে।”

এনবিআরের বিভিন্ন সময় প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

এই সুবিধা বিশেষ মহলকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য: ইফতেখারুজ্জামান

This browser does not support the audio element.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১০০ টাকার নোট বাতিল করে কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সর্বপ্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। এরশাদ সরকারও এই সুযোগ দেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার,আওয়ামী লীগ সরকার সবাই এই সুযোগ দেয় । ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার কালো টাকা সাদা করার  পাশাপাশি সাত শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগও দিয়েছিল। তাতেও কার্যত কোনো লাভ হয়নি৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (আিইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, " কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হলো এর ক্ষতিকর দিক সরকারও জানে। সরকার জানে, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এটা দুর্নীতি সহায়ক, বৈষম্যমূলক, সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটার মাধ্যমে সামান্য অর্থই কর হিসাবে আদায় হয়। কিন্তু তারপরও সরকার এই সুবিধা দিচ্ছে বিশেষ মহলকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য।”

"এই সুযোগ দিয়ে ৫২ বছরে মাত্র চার হাজার ৬০০ কোটি কর পেয়েছে সরকার। কিন্তু এর ফলে সততা আর নৈতিকতার চর্চা বলে কিছু থাকলো না। আর সরকার কালো টাকা বিনিয়োগের যে খাতগুলোর কথা বলেছে সেই খাতগুলো প্রবলভাবে দুর্নীতিবাজদের হাতে চলে যাবে।”

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত ৫০ বছরে দেশে পুঞ্জীভূতমোট কালো টাকার পরিমাণ ছিলো এক কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ