কালো টাকায় সুবিধা বেশি?
১ ডিসেম্বর ২০২০শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা উৎসাহিত হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন৷
এবার কালো টাকা সাদা করার এই হিসাব ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত৷ জাতীয় রাজস্ব কর্তৃপক্ষ এনবিআর আয়কর দেয়ার সময় সীমা আরো এক মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করেছে৷ তাই এনবিআর আশা করছে হয়তো আরো কিছু কালো টাকা সাদা হবে৷
এনবিআর-এর তথ্য মতে এবার কালো টাকা সাদা করেছেন তিন হাজার ৩৫৮ জন৷ ফ্ল্যাট ও জমি কিনে এবং নগদ ও ব্যাংকের টাকা সাদা করেছেন তিন হাজার ২২০ জন৷ তাদের কাছ থেকে সরকার কর পেয়েছে ৩৮১ কোটি ৩১ লাখ টাকা৷ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সাদা করেছেন ১৩৮ জন৷ এখান থেকে কর পাওয়া গেছে পেয়েছে ১৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা৷ মোট কর পাওয়া গেছে চারশ কোটি টাকার কিছু বেশি৷ এরা সবাই তাদের আয়কর রিটার্নে তাদের অপ্রদর্শিত আয়ের উপরে শতকরা ১০ ভাগ কর দিয়েছেন৷ সেই হিসেবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি সাদা হওয়ার কথা৷ কিন্তু সেই টাকার পরিমান প্রকাশ করেনি এনবিআর৷
কালো টাকা বলতে বাংলাদেশের আইনে বৈধ আয় তবে কর দেয়া হয়নি এমন টাকাকে বুঝায়৷ কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশের অন্য আইনে যাই থাক না কেন কেউ শতকরা ১০ ভাগ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করলে ওই অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না৷ ফলে এই টাকা বৈধ না অবৈধ তা নিশ্চিত নয়৷ আইনে অবৈধ টাকা, যার উৎস বৈধ নয় তা আসলে সাদা করা যায় না৷ শুধু মাত্র বৈধ অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ আছে৷ কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রশ্ন না করায় অনেক অবৈধ টাকাই এই প্রক্রিয়ায় বৈধ হয়ে যায়৷ তারপরও অর্থনীতিতে যে পরিমানে কালো টাকা আছে তার অল্প অংশই সাদা হয়৷
২০১১ সালে অর্থমন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয় জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাশং কালো টাকা৷ বিশ্ব্যাংবকের এক জরিপে বলা হয় বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কালো টাকার পরিমাণ ছিলো ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ৷ কিন্তু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র সাত ভাগ কালো টাকা ছিলো৷
দেশে এপর্যন্ত ১৭ বার ঘোষণা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে৷ এরমধ্যে সাবেক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সময় ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে৷ ওই সময়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়৷ সরকার এক হাজার কোটি টাকার বেশি কর পায়৷ আর এবারও কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ বেশি৷ এপর্যন্ত ১৫ অর্থ বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হওয়ার হিসাব আছে এনবিআরের কাছে৷
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ‘‘কালো টাকার খুব বেশি সাদা হয় না৷ আর যে প্রক্রিয়ায় সাদা করা হয় তাতে অবৈধ অর্থও সাদা হয়৷ আসলে বৈধ আয়, যার কর দেয়া হয়নি সেটাকেই সাদা করার সুযোগ আইনে থাকে৷ কিন্তু অর্থমন্ত্রী যখন বলেন উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে না তখন তো অবৈধ অর্থও হালাল হয়ে যায়৷ এতে সাময়িকভাবে অর্থনীতি লাভবান হলেও চূড়ান্ত অর্থে ক্ষতি হয়৷ ঘুস, দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসার মত অবৈধ ব্যবসা উৎসাহিত হয়৷’’
একই সঙ্গে যারা সৎ করদাতা তারা নিরুৎসাহিত হন৷ কারণ কালো টাকার জন্য ফ্ল্যাট রেটে শতকরা ১০ শতাংশ কর৷ কিন্তু যারা সৎ করদাতা তাদের কর সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত৷ এটা বৈষম্য এবং অন্যায় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা৷ সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘যেখানে সৎ করদাতাদের উৎসাহিত করা উচিত সেখানে উল্টোটা করা হচ্ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আসলে কারা কালো টাকার মালিক তাদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থা অর্থনীতিতে থাকা দরকার৷ সেটা থাকলে কালো টাকার উৎপাদন বন্ধ হবে৷ সেটা না থাকায় কালো টাকার মালিকরা যেন এখন প্রণোদনা পাচ্ছেন৷ এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন৷’’
তারা মনে করেন, এভাবে বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযো দিলে যারা অসৎ তারা ট্যাক্স দেবে না৷ তারা সময় বুঝে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেবে৷ আর বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশে কালো টাকার অধিকাংশই ঘুস, দুর্নীতি ও অবৈধ ব্যবসার টাকা৷ তাই যেখানে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলছে সেখানে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার বিরোধী এই দুই অর্থনীতিবিদ৷