ধৃত মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ জেলবন্দি ব্যবসায়ীও টাকা ঢেলেছিলেন টলিউডে। কুন্তল-অয়ন-বাকিবুরদের কালো টাকা সাদা করার মাধ্যম কি বাংলা ছবি?
বিজ্ঞাপন
রেশন দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল বাংলা ছবির প্রযোজনাতেও। প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য পেয়েছে ইডি। ইডির হাতে রেশন দুর্নীতিতে ধরা পড়েছেন মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান। তিনি সিনেমায় টাকা ঢেলেছিলেন।
বাকিবুরের ছবি
'ম্যানগ্রোভ' নামের একটি বাংলা সিনেমার প্রযোজক ছিলেন বাকিবুর। ২০১৪-র এই ছবির টাইটেল কার্ডে তার নাম রয়েছে। সূত্রের খবর, সেই 'ম্যানগ্রোভ' সিনেমার পরিচালক খাদ্য দপ্তরের কর্মী, কাহিনি লিখেছিলেন এই দপ্তরেরই এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। রেশন দুর্নীতিতে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সদ্য গ্রেপ্তার হয়েছেন ইডির হাতে।
এই ছবির কুশীলবদের তালিকাতেও চমক রয়েছে। অভিনয় করেছেন সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। দুজনেই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এখন জেলবন্দি।
এসএসসি কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রী গ্রেপ্তার, বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি
দীর্ঘ জেরার পর গ্রেপ্তার করা হলো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এসএসএসি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে। পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার। তার দাবি, পার্থই টাকা রাখতে বলেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শুক্রবার সকাল থেকে জেরা
শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র অফিসাররা পৌঁছে যান পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে। পার্থ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ঘুম থেকে তুলে শুরু হয় জেরা ও তল্লাশি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা
গ্রেপ্তার করার আগে ২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা করে ইডির অফিসাররা। শুধু পার্থের বাড়ি নয়, মোট ২০টি জায়গা তল্লাশি চালান ইডি-র কর্মকর্তারা। প্রায় ৯০ জন ইডি কর্মী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাতে থাকেন। উপরের ছবিতে কলকাতার নাকতলায় পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের বাড়ি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার
তল্লাশির সময় অভিনেত্রী ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্য়ায়ের ফ্ল্যাট থেকে ২২ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। টাকা অর্পিতার শোয়ার ঘরের আলমারিতে চটের বস্তায় রাখা ছিল। অর্পিতা ইডি-র অফিসারদের জানিয়েছেন, পার্থই তার কাছে টাকা রেখেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাতভর টাকার হিসাব
ইডি-র অফিসাররা ব্যাংক থেকে দশটি টাকা গোনার মেশিন ও কর্মীদের নিয়ে আসেন। সারারাত ধরে টাকা গোনা হয়। দেখা যায়, ২২ কোটি টাকা আছে। তাছাড়া ৫০ লাখ টাকার সোনার গয়না ও প্রচুর ডলার পাওয়া যায়। বেশ কিছু নথিপত্রও নিয়ে গেছে ইডি। অর্পিতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। উপরের ছবিতে অর্পিতার দক্ষিণ কলকাতার আবাসনের ফ্ল্যাটের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কীসের টাকা
আদালতে ইডি জানিয়েছে, অর্পিতা এসএসসি-তে বেআইনি নিয়োগের সঙ্গে জড়িত। তিনি অন্যতম চক্রান্তকারী। তার বাড়িই ছিল নিয়োগের আখড়া। সেই নথিপত্র ইডি পেয়েছে। মন্ত্রীর নামের সরকারি খামও পাওয়া গেছে। অর্পিতা ইডিকে জানিয়েছে, টাকাটা পার্থ চট্টোপাধ্যায তাকে রাখতে দিয়েছিলেন। তিনি এনিয়ে কিছুই জানেন না। ইডি এখন অর্পিতার বাড়ি থেকে পাওয়া বিদেশি মুদ্রা নিয়েও আলাদা মামলা করতে পারে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কে এই অর্পিতা?
অর্পিতা মুখোপাধ্যায় অভিনেত্রী। তিনি বাংলা ও ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাছাড়া তিনি নেল আর্ট করতেন। পার্থর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ফোনে অর্পিতা সারাদিন কথা বলতেন বলে অভিযোগ। তিনি দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী দুর্গাপুজোর সঙ্গেও জড়িত। এই পুজোর সঙ্গে পার্থও য়ুক্ত।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলছেন অর্পিতার মা
মেয়ের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে তার মা মিনতি বলেন, ‘‘বাবা-মা যা চাইবে ছেলেমেয়ে কি সেটাই করবে? সেরকম হলে তো মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম। ওর কথা খবরে শুনেছি। তবে অর্পিতা এই কাজ করেছে কি না, সেই সত্যাসত্যও বিচার করা হবে।’’
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থ হাসপাতালে
গ্রেপ্তার করার পর পার্থকে নিজেদের হেফাজতে রাখে ইডি। তারপর আদালতে পার্থ জানান, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। তখন আদালত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলে। এসএসকেএম হাসাপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। ইডি অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ইডির দাবি মেনে
ইডি পরে কলকাতা হাইকোর্টে জানায়, পার্থকে কল্যাণীর এইমসের চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখুন। কিন্তু বিচারপতি বলেন, কল্যাণীর এইমসের উপর তার ভরসা নেই। পরে তিনি নির্দেশ দেন, ভুবনেশ্বরের এইমসে পার্থর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তিনিকেতনে পার্থর বাড়ি?
শান্তিনেকতনে ছয়টি বাড়ি পার্থর বলে অভিযোগ উঠেছে। তারমধ্যে একটি বাড়ির কেয়ারটেকার বলেছেন, একটি বাড়িতে পার্থর আসা-যাওয়া ছিল। একটি সাত বিঘের জমিও পার্থর বলে অভিযোগ। তবে সরকারি আধিকারিকরা বলেছেন, তারা খোঁজ না করে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থর বিরুদ্ধে অভিযোগ
পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তখন এসএসসি কেলেঙ্কারি হয়। পরীক্ষা দিয়ে যারা উঁচু স্থান পেয়েছে, তাদের চাকরি না দিয়ে, পয়সা দিয়ে নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। এই নিয়োগের বিরুদ্ধে কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই অভিযোগের তদন্ত করছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া
পার্থ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম বরিষ্ঠ মন্ত্রী। মমতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সৈনিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হামেশাই অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে রাজ্যের নেতাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু পার্থকে গ্রেপ্তার করার পর তৃণমূলের বক্তব্য, অভিযোগ প্রমাণ হলে দল ও সরকার ব্যবস্থা নেবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সিপিএমের প্রতিক্রিয়া
সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে এসএসসি চাকুরিপ্রার্থীদের হয়ে মামলা লড়ছেন। বিকাশরঞ্জনের প্রতিক্রিয়া হলো, ''পার্থ হচ্ছেন দাবার ঘুঁটি, ইডির উচিত হরিশ চ্যাটার্জি রোডে তল্লাশি করা। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে।'' তার দাবি, ''ইডি যেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে ধরবে, সেদিন পুরো দুর্নীতি সামনে আসবে।'' সিপিএম কর্মীরা এখন বিভিন্ন জেলায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Abp Photo/Sudipta Bhowmick
বিজেপি, কংগ্রেসের অভিযোগ
বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এসএসসি নিয়ে বিক্ষোভ-মঞ্চে যান। তিনি টুইট করে পার্থ ও অর্পিতা নিয়ে সোচ্চার হন। দিলীপ ঘোষও তাই। কংগ্রেসও এসএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
টলিউডের কয়েকজন বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী ম্যানগ্রোভ ছবিতে কাজ করেছেন। রাখি সাওয়ান্ত, নাইজেল আকারা, দোলন রায় প্রমুখ। কিন্তু ছবি তৈরিতে হঠাৎ কেন বিনিয়োগ করতে গেলেন বাকিবুর? অনুমান করা হচ্ছে, কালো টাকা সাদা করতেই এই কৌশল নেয়া হয়েছিল।
সূত্রের খবর, তদন্তকারীরা বাকিবুরের অন্তত ১০০ কোটির সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছেন। ব্যবসায়ীর নামে-বেনামে কিংবা পরিজনদের পরিচয় ব্যবহার করে সম্পত্তি কেনা হয়েছে। ভুয়ো সংস্থাও তৈরি করা হয়েছিল। এ সবের মধ্যে ছবিতে বিনিয়োগ দুর্নীতির টাকা সরানোর একটি কৌশল ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
কালো টাকা সিনেমায়
দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার মাধ্যম হিসেবে সিনেমায় বিনিয়োগের তথ্য এর আগেও পাওয়া গিয়েছে। স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত সাবেক তৃণমূল যুব নেতা কুন্তল ঘোষ বাংলা ছবিতে বিনিয়োগ করেছিলেন।
টলিউডের পরিচালক ও অভিনেতাদের নাম জড়িয়ে যায় কুন্তলের সঙ্গে। পরিচালক রানা সরকার থেকে অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কুন্তলের টাকায় গাড়ি কিনেছিলেন বনি। কেন্দ্রীয় সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়া এই অভিনেতা গাড়ির জন্য নেয়া ৪০ লক্ষ টাকা ফেরতও দিয়েছেন।
পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার অয়ন শীল টাকা ঢেলেছিলেন ছবি প্রযোজনাতে। ২০২০ সালে 'কাবাড্ডি কাবাড্ডি' নামে একটি ছবি প্রযোজনায় তিনি হাত দেন। শ্বেতা চক্রবর্তী নামে এক মডেল ও অভিনেত্রীর নাম উঠে আসে। এছাড়া টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রযোজনাতেও অয়ন এগিয়ে এসেছিলেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
টলিউডের শীর্ষ তারকা তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব গরু পাচারের টাকায় সিনেমা করেছেন বলে অভিযোগ তোলে বিজেপি। বিধায়ক ও টলিউডের অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের এই অভিযোগ দেব খারিজ করে দিয়েছেন। তবে দেবকে তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে।
শিল্পীদের দায়
টলিউডের অভিনেতা ও শিল্পীরা বারবার বলেছেন, প্রযোজকদের টাকার উৎস বিচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাকিবুরের 'ম্যানগ্রোভ' ছবির অভিনেতা নাইজেল আকারার মন্তব্য, "কেউ কালো টাকা সাদা করার জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন কি না, সেটা আমাদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়। বাকিবুরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিও না।"
‘সরকার এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না’
এই ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দোলন রায়। তিনি বলেন, "বাকিবুরকে চিনতাম না। শুটিংয়ে এসেছেন কি না, সেটাও বলতে পারব না। আমি কাজ করে টাকা নিয়েছি। এখন টাকার উৎস বুঝতে পেরে খারাপ লাগছে।"
অভিনেতা ও বিজেপি নেতা রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, "শাসক দল ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের টাকা টলিউডে ঢালছেন। একের পর এক নাম উঠে আসছে। তবে পরিচালক বা অভিনেতাদের বোঝা মুশকিল টাকা কোথা থেকে আসছে।"
চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হাতে কাজ নেই, কাজ পাওয়া সহজ নয়। তাই একজন অভিনেতা বা শিল্পী প্রযোজককে জিজ্ঞেস করতে পারেন না যে, তার টাকা সাদা না কালো। অমিতাভ বচ্চন বলতে পারেন, কোম্পানির ব্যালেন্স শিট দেখান, তবে অভিনয় করব। সেটা ক'জন পারবেন?"
পরিস্থিতি বদলাবে?
শুধু টলিউড নয়, বলিউড-সহ দেশের অন্যান্য রাজ্যের চলচ্চিত্র শিল্পেও কালো টাকার মৃগয়া অজানা কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর অন্যত্র এমন উদাহরণ রয়েছে। এটা বন্ধ করা কি সম্ভব নয়?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, "সরকার এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কালো টাকার একটা অংশ অর্থনীতির মধ্যে চলে আসে সিনেমায় বিনিয়োগের মাধ্যমে। সেখান থেকে সরকারেরও কিছু প্রাপ্তি হয়। নইলে ওই কালো টাকার নাগাল পাওয়া যেত না।"
অনীক দত্তের বক্তব্য, "শুধু সিনেমা তো নয়, সব শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগ করা হয়। প্রশাসন চাইলে তবেই এটা বন্ধ হতে পারে। অর্থাৎ কঠোর আইন দরকার। অবৈধ টাকার উৎসব বন্ধ হলেই এই বাকিবুররা আর তৈরি হবে না। তা হলে বিনিয়োগের প্রশ্নও আসবে না।"