এবারের ‘গোল্ডেন গ্লোব' অ্যাওয়ার্ডে বহু অভিনেত্রী কালো পোশাক পরে প্রতিবাদ জানালেন বিশ্ব জুড়ে চলা নারী নিগ্রহের৷ এ বছর শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার ছবির শিরোপা পেয়েছে তুর্কি-জার্মান পরিচালক ফাতিহ আকিনের ‘ইন দ্য ফেড'৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার অ্যামেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত হয় পঁচাত্তরতম ‘গোল্ডেন গ্লোব' পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান৷ চলচ্চিত্র বিশ্বের অন্যতম পুরস্কার এটি, যেখানে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয় তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান পরিচালক ফাতিহ আকিনের ‘ইন দ্য ফেড'৷ তবে পুরস্কার নয়, রবিবারের অনুষ্ঠানমঞ্চ আলোড়িত হলো নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে৷
অ্যামেরিকার বিখ্যাত প্রযোজক সংস্থা হার্ভে ব্রাদার্স৷ এক সময় প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিয়েছিল ডিজনি৷ পরবর্তীকালে হার্ভে ব্রাদার্স আরও একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে৷ অভিযোগ, নব্বইয়ের দশক থেকে একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন হার্ভে ব্রাদার্সের অন্যতম হার্ভে উইনস্টাইন৷ ২০১৭ সালে ‘নিউ ইয়র্কার' পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বব তাঁর ভাই হার্ভের নারী নিগ্রহের ঘটনা চাপা দেওয়ার জন্য কয়েক লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিলেন ব্রিটেনের দুই মহিলাকে৷ ওই দুই মহিলাই হার্ভের নিগ্রহের শিকার৷
খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চলচ্চিত্র কুশিলব এবং চলচ্চিত্রপ্রেমীরা প্রতিবাদে মুখর হন৷ শুধু তাই নয়, অন্যান্য প্রযোজকদের হাতে নিগৃহিতারাও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেন৷ ‘নিউ ইয়র্কার'এর সেই রিপোর্টের পর প্রথম ‘গোল্ডেন গ্লোব'-এর মঞ্চে একত্রিত হন চলচ্চিত্রের কুশিলবেরা৷ সে কারণেই কালো পোশাক পরে তাঁরা প্রতিবাদ জানান৷ শুধু তাই নয়, তাঁদের প্রতিবাদে উঠে আসে আরও বিভিন্ন তথ্য৷ বিভিন্ন সময় নিগৃহিত হওয়ার কাহিনি৷ কেউ কেউ ‘মি টু' হ্যাশ ট্যাগও ব্যবহার করেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে৷
অষ্টমবার ‘গোল্ডেন গ্লোব' বিজেতা মেরিল স্ট্রিপ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি এখন যথেষ্ট আলোচিত৷ সেই বৈষম্যই নারী নিগ্রহের জন্য দায়ী৷ সকলে একসঙ্গে কালো পোশাক পরে আমরা সেই বৈষম্যই তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷''
‘অল দ্য মানি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড' ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কৃত হন মিশেল উইলিয়ামস৷ মঞ্চে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান ‘মি টু' হ্যাশট্যাগের প্রণেতা তারানা বুর্কেকে৷
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে পুরস্কৃত করা হয় তুর্কি-জার্মান পরিচালক ফাতিহ আকিনকে৷ ‘ইন দ্য ফেড' ছবিতে আকিন বলেছেন এক তুর্কি পরিবারের গল্প৷ পরিবারটির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে সন্ত্রাসবাদের কাহিনি৷ পরবর্তীকালে জার্মানিতে যাঁরা দক্ষিণপন্থিদের বোমা হামলার শিকার হন৷ কিন্তু জার্মান প্রশাসন বিষয়টিকে অন্যভাবে বিচার করে৷ তারা এর সঙ্গে মাদক ব্যবসার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে৷ সেই ভুয়া অভিযোগের বিরুদ্ধে একা লড়াই চালিয়ে যান বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া কাটজা৷
শুধু ‘গোল্ডেন গ্লোব'-র মঞ্চেই নয়, সারা বিশ্বেই সমাদৃত হয়েছে ফাতিহ আকিনের এই ছবি৷ পুরস্কার পাওয়ার পর তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে বলেই বিশ্বাস পরিচালকের৷
বাংলা চলচ্চিত্রের এ কী দশা
চলছে বাংলা চলচ্চিত্রের চরম দুঃসময়৷ মানসম্পন্ন সিনেমার অভাবে দর্শকরা যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে৷ দর্শকের অভাবে বহু সিনেমা হল বন্ধ৷ আর যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও চলছে ধুকে ধুকে৷ ছবিঘরে থাকছে সেই গল্পই৷
ছবি: Getty Images
এখনো আছে মধুমিতা
ঢাকার প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো সিনেমা হল ‘মধুমিতা’ টিকে আছে এখনো৷ প্রায় ৬০ বছর আগে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছিল৷ মাঝে অনেকটা সোনালি সময় পার করেছে এই চলচ্চিত্র৷ কিন্তু পাঁচ যুগ পরে এসে এখন তা অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বিপর্যয়
১৯৯৯ সাল থেকে এ দেশে ব্যাপক হারে অশ্লীলতানির্ভর নিম্নমানের ছবি নির্মাণ শুরু হয়৷ সাধারণ দর্শক তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেরকম ছবি দেখার কথা ভাবতেই পারেনি৷ এছাড়া সিনেমা হলে মৌলবাদীদের হামলার ঘটনাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বিপর্যয়ের আরেক কারণ৷
ছবি: Getty Images
এক হলে ১৩ জন দর্শক!
হাটখোলা এলাকায় ঢাকার আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ‘অভিসার’৷ এ ছবি তোলার সময় সেখানে প্রদর্শনী চলছিল প্রায় এক হাজার আসনের এ সিনেমা হলে এ প্রদর্শনীতে সর্বমোট দর্শক সংখ্যা ছিলেন মাত্র ১৩ জন৷
ছবি: DW/M. Mamun
দুরবস্থার কারণ
২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার অভিসার সিনেমা হল পরিচালনায় যুক্ত কবির হোসেন৷ চলচ্চিত্রের এ দুর্দশার জন্য তিনি সিনেমার মান আর বিভিন্ন সহজলভ্য স্যাটেলাইট টেলিভিশনকেই দায়ী করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভালো ছবির কদর
ঢাকার আরেকটি সিনেমা হলের পরিচালক মতিন মিয়া৷ ঢাকার ‘গীত সঙ্গীত’ সিনেমা হল পরিচালনা করছেন তিনি গত প্রায় আঠারো বছর ধরে৷ তাঁর মতে ভালো নির্মাতা, নায়ক-নায়িকার অভাবই চলচ্চিত্রের দুর্দশার মূল কারণ৷ কেননা, এখনো দু-একটি ভালো সিনেমা এলে হল ভর্তি দর্শক দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ব্যবসা কোথায়?
ছবিটি ঢাকার ‘গীত’ সিনেমা হলের৷ প্রায় দর্শকশূন্য হল৷ প্রায় ১১০০ আসনের এ হলে সেদিন দর্শক ছিল মাত্র ৩৪ জন৷ হলমালিকরা এ পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করেন৷ তাঁদের প্রশ্ন – এমন চলতে থাকলে ব্যবসা চালানো কিভাবে সম্ভব?
ছবি: DW/M. Mamun
দুর্দশার আরেকটি চিত্র
ঢাকার আরেক সিনেমা হল ‘সঙ্গীত’-এরও একই অবস্থা৷ এ হলেও প্রায় সব আসন ফাঁকা রেখে শো চালানো প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বন্ধ হলো ‘গীত’ ও ‘সঙ্গীত’
ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকায় ‘গীত’ ও ‘সঙ্গীত’ সিনেমা হল৷ গত প্রায় দশ বছর ধরে ধুকে ধুকে চলার পর এ বছর রোজার আগেই বন্ধ করা হচ্ছে হল দুটি৷ এক সময় সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২০০ টি৷ বন্ধ হতে হতে এখন সারা দেশে সিনেমা হল টিকে আছে ২০০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
সিনেমা হলের জায়গায় মার্কেট কমপ্লেক্স
বাংলাদেশে সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক শুরু হয় মূলত ২০০১ সাল থেকে৷ ঢাকার ‘গুলিস্তান’ ও ‘নাজ’ সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করা হয় মার্কেট কমপ্লেক্স৷ একইভাবে পুরনো ঢাকার ‘মুন’ ও ‘স্টার’ সিনেমা হল ভেঙেও করা হয়েছে বিশাল মার্কেট৷ এভাবে পুরনো ঢাকার ‘শাবিস্তান’, পোস্তগোলার ‘পদ্মা’, ‘মেঘনা’, ‘যমুনা’ ইত্যাদি সিনেমা হলও একে একে বন্ধ হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
হল ভেঙে নতুন হল
ঢাকার ‘শ্যামলী’ সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হলেও সেখানে আধুনিক একটি সিনেমা হল রাখা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
দর্শক অশ্লীলতাবিমুখ
ঢাকার মিরপুরের ‘সনি’ সিনেমা হলে ৩২ বছর ধরে কাজ করছেন সামাদ মিয়া৷ তাঁর হলে একসময় অনেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে আসতেন৷ কিন্তু এখন আর সে দৃশ্য তিনি দেখেন না৷ সেজন্য সিনেমার অশ্লীলতাকে দায়ী করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
টিকে থাকার কৌশল
ঢাকায় যে ক’টি হল টিকে আছে, তার মধ্যে মিরপুরের ‘সনি’ সিনেমা হল একটি৷ দীর্ঘ দিন লোকসান দিয়ে হলটি টিকিয়ে রেখেছেন এক সময়ের চলচ্চিত্র পরিচালক মোহামম্দ হোসেন৷ এই কমপ্লেক্সে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকায় লোকসান দিয়েও চালানো সম্ভব হচ্ছে হলটির কার্যক্রম৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় হল কমে প্রায় অর্ধেক
ঢাকার দারুসসালাম এলাকায় আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ‘এশিয়া’৷ গাবতলী বাস স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় এ সিনেমা হলটির দর্শক ঢাকার অন্যান্য হলের তুলনায় কিছুটা বেশি৷ আশির দশকে ঢাকা শহরে ছিল ৪৪টি সিনেমা হল৷ বর্তমানে কমতে কমতে সংখ্যাটি পঁচিশেরও নীচে নেমে এসেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাধারণ দর্শক যা মনে করেন
ঢাকার সাধারণ হলগুলোতে নিয়মিত সিনেমা দেখেন রুবেল৷ তাঁর মতে, আগে সিনেমাগুলো অনেক কাহিনিনির্ভর ছিল, কিন্তু বর্তমানের সিনেমাগুলোর কাহিনি থেকে শুরু করে নির্মাণ কৌশল সবকিছুই খারাপ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরোক্ষে মৌলবাদ
অনেকেই মনে করেন, বাংলা চলচ্চিত্র থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অন্যতম কারণ অশ্লীলতা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অপর্যাপ্ত আধুনিকায়ন
চলচ্চিত্রে সংকটময় এই পরিস্থিতির জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা৷ চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযুক্তির ব্যবহারও খুব বেশি বাড়েনি৷ বিগত বছরগুলোতে বিএফডিসির কোনো আধুনিকায়নই হয়নি৷ সাভারের কবিরপুরে ফিল্ম সিটি গড়ে তোলার জন্য ১০৫ একর জমি বরাদ্দ হলেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পর্নো ছবি
ঢাকার কিছু সিনেমা হলে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে বিদেশি সিনেমা৷ ‘এক টিকেটে ২ ছবি’-র এসব প্রদর্শনীতে মূলত দেখানো হয় পর্নো সিনেমা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাল্টিপ্লেক্সই ভরসা?
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন সিনেমা হল বন্ধের মহোৎসব চলছে, সে সময়ে কিছুটা হলেও দর্শক নিয়ে আসছে ঢাকার মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলগুলো৷ সংখ্যায় খুবই কম হলেও ভালো পরিবেশের কারণে এসব মাল্টিপ্লেক্স হলে দর্শকরা আসছেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাল্টিপ্লেক্সে বেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র
বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রতিদিনই দর্শকরা ভিড় জমান বিভিন্ন সিনেমা দেখতে। তবে এসব সিনেমা হলে প্রদর্শিত সিনেমার অধিকাংশই বিদেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবারের সবার বিনোদনের স্থান
ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে স্টার সিনেপ্লেক্স মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলের একটি৷ পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে দর্শকরা আসেন সিনেমা দেখতে৷