1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আপেল ক্ষেতে রেললাইন, কাশ্মীরের চাষিদের লড়াই

মোহাম্মদ আবু বকর/টিআই২১ নভেম্বর ২০২৪

কাশ্মীরের বসন্ত মানেই পাহাড়ের কোলে আপেলের কুঁড়ি ফোটার সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু এ বছর, কাশ্মীরের রেশিপোরা গ্রামের আপেল বাগানে ছড়িয়ে আছে এক অজানা ভয়।

ভারত সরকার কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছে। আর রেলের এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরি আপেল চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করছেন, এই প্রকল্প তাদের আপেল বাগান এবং জীবিকা ধ্বংস করবে।
কাশ্মীরে অনেকে আপেল চাষ করেন ছবি: Idrees Abbas/ZUMA Press/IMAGO

ভারত সরকার কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছে। আর রেলের এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরি আপেল চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করছেন, এই প্রকল্প তাদের আপেল বাগান এবং জীবিকা ধ্বংস করবে।

সরকারের এমন প্রকল্প সম্পর্কে বিশ বছর বয়সি মেহবিশ মুজাফ্ফর তার মতামত জানিয়েছেন৷

সেদিন মেহবিশ একটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা তাকে স্তম্ভিত করে দেয়। সেই বার্তায় বলা হয়েছিল, রেশিপোরায় গ্রামে জরিপকারীরা এসেছে। এই জরিপকারীরা ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেলপথ তৈরির জন্য আপেল বাগানের জমি চিহ্নিত করবে।

মেহবিশ বলেন, "এই বার্তা আমাদের জন্য এতটা ভয়াবহ যে আমি খবরটা পড়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম৷" 

অস্তিত্ব সংকটে কাশ্মীরের চামড়া শিল্প

03:02

This browser does not support the video element.

মেহবিশের কাছ থেকে এই তথ্য তার মা দিলশাদা বেগম পেয়ে যান। আর তিনি গ্রামের অন্য নারীদের মতো দৌড়ে চলে যান তাদের আপেল বাগানে। মেহবিশের পরিবার এই বাগানের উপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এই বাগান থেকে তাদের বার্ষিক আয় প্রায়১৩ হাজার ইউরো বা ১২ লাখ রুপি।

দিলশাদা বলেন, "এই জমি আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। এই বাগান আমাদের জীবন।"

কিন্তু ভারত সরকারের রেল সম্প্রসারণ পরিকল্পনা মেহবিশের মতো পরিবারগুলোর জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে এসেছে।

রেশিপোরা গ্রামটি কাশ্মীরের শোপিয়ান অঞ্চলের একটি ছোট অংশ। এই অঞ্চলে আপেল শুধু অর্থনীতির মেরুদণ্ড নয়, এটি ওই অঞ্চলের অনেক মানুষের জীবন ধারনের অবলম্বন৷

দিলশাদা ও তার অসুস্থ স্বামী তাদের চার মেয়েকে এই বাগানের আয়ে বড় করেছেন। এমন আরও প্রায় ৩০০ পরিবার রয়েছে যাদের জীবিকা এই বাগানের উপর নির্ভরশীল।

শুধু দিলশাদার পরিবার নয়, সরকারের এই পরিকল্পনার ভয়াবহতা বোঝা যায় ৫৬ বছর বয়সী কৃষক মোহাম্মদ ইউসুফ রেশি-এর কথাতেও। ইউসুফ বলেন, "আপেল ছাড়া শোপিয়ান কল্পনাও করা যায় না।" রেশি এতটাই হতাশ যে জমি কেড়ে নেয়ার চেয়ে চাষিদের মৃত্যুকেও শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।

এই বাগানগুলো শুধু রেশিপোরা গ্রাম নয়, বরং পুরো শোপিয়ান জেলার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকেরা জানালেন, জরিপকারীরা কোনো নোটিশ ছাড়াই জমিতে এসে কাজ শুরু করে। তারা ড্রোন এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে বাগানের মাটি পরিমাপ করতে থাকে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারত সরকার কাশ্মীরে পাঁচটি নতুন রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে আওয়ান্তিপোরা-শোপিয়ান লাইন অন্যতম। সমালোচকরা বলছেন, প্রস্তাবিত পাঁচটি রেলপথ নির্মাণে প্রায় ২৮৮ হেক্টর জমি (৭১২ একর) লাগবে, যার বেশিরভাগই উর্বর জমি।

রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ বলেছেন, এই রেলপথ শুধু যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে না, কাশ্মীরের পর্যটন এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও খুলে দেবে। উত্তর রেলের মুখপাত্র হিমাংশু শেখর বলেছেন, "কিছু গাছ হয়তো কাটতে হবে, তবে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আরও অনেক গাছ লাগানো হবে।"

কাশ্মীরে বেকারত্বের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। সেখানকার আপেল চাষিদের কাছ থেকে তাদের জমি কেড়ে নেয়া মানে তাদের জীবিকার শেষ ব্যবস্থাটুকুও চলে নেয়া। আর তাই নানা আশ্বাস কৃষকদের জন্য কোনো সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করছে না। ২৭ বছরের আজহার ওয়ানির কথাতেই তা স্পষ্ট। আজহার অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করছেন। তিনি বলেন, "জমি গেলে চাকরি তো দূরের কথা, আমাদের টিকে থাকাই মুশকিল হবে।"

গত এপ্রিলে রেশিপোরা গ্রামের কৃষকেরা বাগানে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ করেন। তাদের ভাষায়, এই প্রকল্প তাদের ভবিষ্যৎকে কবর দেবে।

সরকারের এমন পরিকল্পনার বিপরীতে ওই অঞ্চলের কৃষকেরা একটি বিকল্প পথের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমির ওপর দিয়ে রেললাইন নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার বলছে কৃষকদের প্রস্তাবিত বিকল্প পথ অনেক দীর্ঘ।

কৃষক ইউসুফ রেশি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, "প্রথমে আমাদের বলা হয়েছিল ৩০০ ফুট জমি লাগবে, পরে আবার ৯০০ ফুট জমির কথা বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদেরকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে।" 

‘ভূস্বর্গ’ কাশ্মীরে পর্যটনের চেনা-অচেনা বিপদ

02:06

This browser does not support the video element.

রেলপথ নির্মাণের এই পরিকল্পনার ফলে রেশিপোরা গ্রামের দৃশ্য এখন আর আগের মতো নেই। একদিকে আপেলের গাছে ফুল ফুটেছে, অন্যদিকে কৃষকদের চোখেমুখে উদ্বেগের ছায়া। তবুও কৃষকেরা লড়াই করার কথা বলছেন।

দিলশাদা বেগম তাদের বাগানে দাঁড়িয়ে বলেন, "এই জমি শুধু মাটি নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব। এটি আমাদের ছেড়ে দিতে বললে আমরা লড়াই করবো।"

তবে সরকার আপাতত কোনকিছুকেই পাত্তা দিতে না। রেলের মুখপাত্রের দাবি, রেলপথ শোপিয়ানের জন্য আশীর্বাদ হবে। তিনি কৃষকদের ক্ষোভকে যৌক্তিক মনে করলেও জমি অধিগ্রহণের পর চাকরির প্রতিশ্রুতি সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিবে বলে মনে করছেন।

পরিবেশবিদ রাজা মুজাফ্ফর এই পরিকল্পনাকে কেবল ধ্বংসের শুরু হিসেবে দেখছেন। তার মতে, "এই প্রকল্প পরিবেশের ক্ষতি করবে এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার নীতি লঙ্ঘন করবে।"

শেষ পর্যন্ত এই আপেল বাগানের কী হবে সেটা হয়তো নির্ভর করছে একটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের উপর। কিন্তু দিলশাদা বেগমের কণ্ঠে প্রতিজ্ঞা স্পষ্ট, "আমাদের জীবন এখানেই। আমরা এটা হারাতে পারি না।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ