ভোটের কাশ্মীরে নিরাপত্তারক্ষীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হাইব্রিড' সন্ত্রাসীরা।
শ্রীনগরে এখন সন্ত্রাসের ঘটনা এখন অনেকটাই কমে গেছে। পর্যটকে ভরে গেছে কাশ্মীর। ছবি: Goutam Hore/DW
বিজ্ঞাপন
হাইব্রিডরা চেনা সন্ত্রাসবাদী নয়, পুলিশের খাতায় তাদের নাম নেই। তারা এমনিতে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। সেরকম কিছু মানুষের হাতে সাময়িকভাবে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা। সহিংমসতার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তারা চুপচাপ সেই কাজটা করে চলে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনে। এদেরই বলা হচ্ছে ‘হাইব্রিড'।
কাশ্মীরের সর্বত্র মোতায়েন রয়েছে আধা সেনা বাহিনী। একটু দূরে দূরেই রাস্তায়, গুরুত্বপূর্ণ ভবনের সামনে, ছাদে চোখে পড়বে তাদের। রাস্তায় সমানে চক্কর দিচ্ছে সিআরপিএফের গাড়ি। নিরাপত্তার এই আবহে সহিংসতা আগের তুলনায় অনেকটাই কম।
সূত্র জানাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে কৌশল বদল করছে সন্ত্রাসবাদীরা। তারা সন্ত্রাসের কাজে যুক্ত করছে হাইব্রিডদের। এই হাইব্রিডরা অনেকটা সুপারি কিলারের মতো। তাদের উপর নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা কাজ শেষ করে অস্ত্র ফেরত দিয়ে দিচ্ছে। তারপর পেশাগত কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে করছে। সময় কাটাচ্ছে পরিবারের সঙ্গে।
আগে কাশ্মীরের তরুণরা সন্ত্রাসবাদী হলে রীতিমতো সামাজিক মাধ্যমে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার ছবি দিয়ে ঘোষণা করে দিত, তারা সন্ত্রাসে, সহিংসতায় দীক্ষিত হয়েছে। ফলে তাদের চিহ্নিত করতে, তাদের মোকাবিলা করতে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছুটা সুবিধা হত। এখন হাইব্রিডদের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা নেই।
কাশ্মীরের প্রচারে হইচই নেই, আছে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা
কাশ্মীরে ভোটপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। তবে তার চেহারা একেবারেই অন্যরকম। অন্য জায়গার সঙ্গে সেই প্রচার মিলবে না।
ছবি: AB Raoof Ginie/DW
ওমর আবদুল্লার কর্মীসভা
কাশ্মীরে সবকটি দলীয় অফিসে আছে কড়া নিরাপত্তা। ন্যাশনাল কনফারেন্স বা এনসি অফিসে দলের কর্মীদের সভা ডেকেছিলেন ওমর আবদুল্লা। তাই বৃহস্পতিবার এনসি অফিস ছিল দলের কর্মীদের উপস্থিতিতে রীতিমতো প্রাণচঞ্চল। তবে সেখানেও পতাকা, ব্যানার যৎসামান্য। তবে কাশ্মীরে বিরোধী দলগুলির মধ্যে এনসি অফিসেই তৎপরতা সবচেয়ে বেশি।
ছবি: AB Raoof Ginie/DW
কর্মীদের উৎসাহ
ন্যাশনাল কনফারেন্স হলো কাশ্মীর উপত্যকায় প্রধান বিজেপি-বিরেোধী দল। গতবার তারা কাশ্মীরের তিনটি আসনেই জিতেছিল। এবার ৩৭০ ধারা বিলোপের পর প্রথম নির্বাচন। তাই ওমর নিজে না লড়লেও দলকে জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি তিনটি আসনেই জিততে চান। তিনিও এখন মূলত কর্মীসভা করছেন।
ছবি: AB Raoof Ginie/DW
ওমর যা বললেন
দলের কর্মীদের ওমর বললেন, এই লোকসভা ভোট হলো সেমিফাইনাল। বিধানসভা ভোট হলো ফাইনাল। এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে তার ঘোষণা, জম্মু ও কাশ্মীর যতদিন পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা না পাচ্ছে, ততদিন তিনি নির্বাচনে লড়বেন না
ছবি: AB Raoof Ginie/DW
টের পাওয়া যায় না
শ্রীনগর-সহ কাশ্মীরের য়ে কোনও জায়গায় যান, আপনার দেখে একবারের জন্যও মনে হবে না ভোট হচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ বা দক্ষিণ ভারতের ভোট দেখে যারা অভ্যস্ত তাদের। কোনো পোস্টার, ব্যানার, মিছিল, মিটিং কিছুই নেই। দেওয়াল লিখন তো দূরের কথা, এক টুকরো প্রচারপত্র পর্যন্ত কোথাও নেই।
ছবি: Goutam Hore/DW
তাহলে কীভাবে প্রচার চলছে?
মেহবুবা মুফতির দল হলো পিডিপি। তারা এখনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। কিন্তু প্রচার শুরু করেছে। কেমন সেই প্রচার? পিডিপি নেতা মোহিত ভান বললেন, ''গুলমার্গ জেলায় গ্রামে প্রচার হবে। চলুন দেখবেন। সেই প্রচার দেখাও একটা অভিজ্ঞতা।''
ছবি: Goutam Hore/DW
বরফের পাহাড় ও সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে
শ্রীনগর ছাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর সেই গ্রাম এলো। তার আগে দেখা গেল সর্ষে ক্ষেত, আপেলের বাগান, আখরোটের চাষ ও পিছনে পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের মাথায় বরফ পড়ে আছে। সেই অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে গ্রামে পৌঁছানো গেল।
ছবি: Goutam Hore/DW
বাড়ির ভিতরে
একটি বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন মোহিত। দোতলায় একটা বড় ঘর। সেখানে জনা ৪০-৪৫ জন মানুষ। কার্পেট পাতা ঘরে তারা বসে। দেওয়ালে কাশ্মীরের বিখ্য়াত কাঠের কাজ। গ্রামের মানুষকে বোঝাতে শুরু করলেন মোহিতরা। কেন ভোট দেবেন? কেন পিডিপি-কে ভোট দেবেন? চিৎকার নয়, রঙ্গব্যঙ্গ নয়, সহজভাবে বাড়িতে বসে আলোচনার ভঙ্গিতে কথা হলো।
ছবি: Goutam Hore/DW
হলো কথপোকথন
প্রথমে পিডিপি নেতারা বললেন। তারপর শ্রোতারাও প্রশ্ন শুরু করলেন। সওয়াল-জবাব হলো। পরে মোহিত বলছিলেন, মানুষ একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে, তাদের জনপ্রতিনিধি দরকার। তাদের এমন একজনকে দরকার, যার কাছে গিয়ে তারা নিজেদের কথা বলতে পারেন। না হলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। এই জায়গাটা হলো মুফতি পরিবারের শক্ত জমি। তারা সেই জমি ধরে রাখতে চাইছেন।
ছবি: Goutam Hore/DW
ফারাক আছে
এনসি ও পিডিপি-র প্রচারের মধ্যে তাই ফারাক আছে। ওমর তার কর্মীদের আগে চাঙ্গা করছেন। আর পিডিপি একেবারে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। মোহিত বলছিলেন, ''এভাবেই আমরা প্রচার করব বলে ঠিক করেছি। কারণ, ৪০ জন মানুষের থেকেই আমাদের প্রচারের কথা চার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। আর সরাসরি কথাবার্তার একটা আলাদা তাৎপর্য আছে।''
ছবি: Goutam Hore/DW
তারিগামি লড়বেন না
সিপিএমের ইউসুফ তারিগামি জানিয়েছেন, তার দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাশ্মীর থেকে লড়বে না। তারা বিরোধীদের সমর্থন করবে। কিন্তু নিজেরা প্রার্থী দেবে না।
ছবি: Goutam Hore/DW
মানুষ ভোট দেবে
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতা মনে করছেন, কাশ্মীরে এবার প্রচুর ভোট পড়বে। মানুষ ভোট দেবে। বিজেপি বলছে, মানুষ উন্নয়নের স্বাদ পেয়েছে বলে ভোট দেবে। এনসি, পিডিপি, সিপিএম, কংগ্রেস নেতারা বলছেন, মানুষ বিজেপি-র নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ভোট দেবে।
ছবি: Goutam Hore/DW
11 ছবি1 | 11
শ্রীনগরের এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, সম্প্রতি এরকম দুইটি ঘটনা ঘটেছে। দুইটি ক্ষেত্রেই কয়েকদিনের মধ্যে পুলিশ হাইব্রিডকে চিহ্নিত করে, তাকে ধরতে পেরেছে। শুধু কয়েকদিন সময় লেগেছে।
বিরোধী রাজনীতিকরা হাইব্রিডদের প্রসঙ্গ তুলছেন। তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে ভালো হয়েছে, এটা ঠিক, তবে শান্তি এসেছে এটা বলা যাবে না। সিপিএমের ইউসুফ তারিগামি, এনসি-র ইমরান নবি ডর, পিডিপি-র মোহিত ভান, পণ্ডিতদের নেতা সঞ্জয় টিক্কু সকলেই এবিষয়ে একমত। তাদের অনেকেই হাইব্রিড-দের প্রসঙ্গ তুলে জানিয়েছেন, ভালো পেশার সঙ্গে যুক্ত, শিক্ষিত এই অজানা সন্ত্রাসীরা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কাশ্মীরের এই আপাত শান্তির পিছনে অশান্তির মেঘও আছে।
কিন্তু কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, হাইব্রিডদের সহিংসতার খুব বেশি ঘটনা ঘটেনি। ভোটের কাশ্মীরেও সহিংসতার ঘটনা নেই বললেই চলে। তারা অবশ্যই সতর্ক। কিন্তু এখনই অ্যালার্ম বেল বাজানোর কারণ ঘটেনি।
তারিগামির দাবি, কাশ্মীরের পরিস্থিতি অনেকটা ঝড়ের আগের শান্তির মতো। পণ্ডিতদের নেতা সঞ্জয় টিক্কু বলছেন, ‘'পর্যটক হিসাবে ঘুরে দেখলে মনে হবে, সব ঠিক। আমরা যারা এখানে আছি, তাদের কাছে পরিস্থিতিটা চিন্তার। কার পকেটে রিভলভার আছে তা কে জানে?''
এক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর একটা জায়গা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হয়েছে। দু-একটা জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের সংঘর্ষ হয়েছে। শ্রীনগর ও আশপাশের এলাকা কার্যত ঘটনাশূন্য। কিন্তু সীমান্তের দিকে কিছু উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা এখনো আছে। সেই এলাকাও অনেকটা শান্ত। যেহেতু কাশ্মীরে নিরাপত্তা নিয়ে ‘জিরো টলারেন্স' নীতি নেয়া হয়েছে। তাই হাইব্রিড-দের নিয়ে চিন্তা তো আছেই।