কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসীদের হামলা নিয়ে নিন্দায় মুখর হলেন ডনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুটিন-সহ বিশ্বনেতারা।
পহেলগামে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করেছেন বিশ্বনেতারা। ছবি: ANI Grab
বিজ্ঞাপন
পহেলগামের পর্যকদের উপর সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফোন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তিনি এই ঘটনায় গভীর শোকপ্রকাশ করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে বলেছেন, ''প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি এই ঘৃণ্য আক্রমণে দোষীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে পূর্ণ সমর্থন করবেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে আছে।''
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে বলেছেন, ''কাশ্মীরের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। অ্যামেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়াবে। আমরা মৃতদের আত্মার জন্য প্রার্থনা করি। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ভারতের অসাধারণ মানুষদের পাশে আছি আমরা।''
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স এখন ভারতে। তিনি বলেছেন, ''গত কয়েকদিন আমরা ভারত ও তার মানুষকে দেখছি। অপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমাদের প্রার্থনা ও ভাবনা ভারতের মানুষের সঙ্গে থাকলো, যারা ওই ভয়ংকর আক্রমণের ফলে শোকাহত।''
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বলেছেন, ''এই নির্মম আক্রমণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা আশা করি, এই আক্রমণ ও চক্রান্ত যারা করেছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি হবে।''
পুটিন বলেছেন, ''সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাশিয়া ভারতের সঙ্গে আছে।''
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অন্তেনিও গুতেরেস এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, ''কোনো পরিস্থিতিতেই এই ধরনের হামলা গ্রহণযোগ্য নয়।'' যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার বলেছেন, ''ভয়ংকর ও বিপর্যস্ত হওয়ার মতো ঘটনা। ভারতের মানুষের ও দুর্গতদের পাশে আছি।''
ইইউ-র প্রধান উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেছেন, ''পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ফলে প্রচুর নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমি জানি ভারতের মনোবল এভাবে ভাঙা যাবে না। এই হামলার পর ভারত আরো শক্তিশালী হয়ে সামনে আসবে। ইইউ ভারতের পাশে থাকবে।'' জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন।
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এই ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেছেন, তার দেশ ভারতের পাশে আছে। এই শোকের সময়ে তারা সবধরনের সাহায্য করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এক বিবৃতিতে ঘটনার কড়া নিন্দা করেছে।
ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি বলেছেন, ঘটনার কথা শুনে তিনি শোকস্তব্ধ। ইটালি ভারতীয়দের পাশে আছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পর্যটকদের উপর এই আক্রমণে তিনি শোকাহত। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ইসরায়েলও ভারতের সঙ্গে আছে।
ইরান জানিয়েছে, তারা এই শোকের সময়ে ভারতের পাশে আছে। যারা মারা গেছেন তাদের জন্য শোকপ্রকাশ করেছে ইরান। শ্রীলঙ্কা জানিয়েছে, তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। তারা ভারত সরকার ও ভারতীয়দের পাশে আছে।
জাতীয় স্তরে প্রতিক্রিয়া
বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী জানিয়েছেন, তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, কাশ্মীরে কংগ্রেস সভাপতি তারিক কারার সঙ্গে পহেলগামে ভয়ংকর আক্রমণ নিয়ে কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, ''নিহতদের পরিবারকে ন্যায় দিতে হবে। তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরো দেশ একজোট।" তবে রাহুল বলেছেন, সরকারের উচিত এই ঘটনার দায় নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া যাতে ভবিষ্যতে তা না ঘটে।
বৃহস্পতিবার কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক হবে।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, ''এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দিতেই হবে। সীমান্তপারের এই আক্রমণেরও জবাব দিতে হবে। সরকারের উচিত, সব দলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা।''
সিপিএম বলেছে, ''কাশ্মীরে শান্তি ফেরা নিয়ে সরকারের দাবি যে কতটা অসার, তা বোঝা গেছে।''
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেছেন, ''দায় কার সেই বিতর্ক অর্থহীন। আমাদের রাজ্যে পর্যটকদের উপর এই আক্রমণ মেনে নেয়া যায় না। যারা হামলা করেছে তারা ঘৃণ্য জীব, অমানুষ।''