কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসার হুমকি পণ্ডিতদের। নিয়মিত পণ্ডিত ও অ-কাশ্মীরিদের হত্যার পর এই হুমকি। পণ্ডিতরা যাতে যেতে না পারেন, সেজন্য তাদের শিবির সিল করে দেয়া হলো।
বিজ্ঞাপন
গত তিনদিনের মধ্যে কাশ্মীরের কুলগামে দুইটি হত্যা হয়েছে। একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং একজন ব্যাংক ম্যানেজারের। শুধু এই দুইটি হত্যাই নয়, কিছুদিন ধরে সন্ত্রাসীরা পণ্ডিত ও অ-কাশ্মীরিদের টার্গেট করেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের হিসাব হলো, জানুয়ারি থেকে ১৬জনকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরই প্রায় চার হাজার পণ্ডিত হুমকি দিয়েছেন, সরকার যদি তাদের নিরাপত্তা না দিতে পারে, তাহলে তারা কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাবেন।
তাদের দাবি, আপাতত, তাদের নিরাপদ কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হোক। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, শান্ত হলে, তারা আবার কাশ্মীরে ফিরবেন। এই চার হাজার পণ্ডিতকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্যাকেজ অনুযায়ী চাকরি দেয়া হয়েছিল।
এনডিটিভি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা যে ট্রানজিট ক্যাম্পে থাকেন, বুধবার সেই সব শিবিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাউকে সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছে না। পণ্ডিতদেরও বেরোতে দেয়া হচ্ছে না। শ্রীনগরের পাশে ইন্দ্রনগর সহ অনেকগুলি শিবিরের ছবি একই।
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
সবচেয়ে বড় শিবির হলো ভেসু পণ্ডিত কলোনি। সেখানে কয়েকশ পণ্ডিত বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, স্লোগান দিয়েছেন। সেখানেও শিবিরের প্রধান দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এক বিক্ষোভকারী সংবাদসংস্থা পিটিআইকে বলেছেন,''আমরা ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করব। তারমধ্যে সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে আমরা সবাই আবার ফিরে যাব।'' তিনি জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে লেফটন্যান্ট গভর্নর বা এলজি মনোজ সিনহার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে তাকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তারা উপত্যকায় ফিরতে চান না। তাদের আপাতত অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হোক। পুলিশের আইজি-ও বলেছেন, কাশ্মীরকে সন্ত্রাস-মুক্ত করতে একটু সময় লাগবে।
কুলগামে শিক্ষক ও ব্যাংক ম্যানেজারকে হত্যার পর পণ্ডিতরা ক্ষুব্ধ। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে একজন বিক্ষোভকারী জানিয়েছেন, ''এক হাজার ২৫০ জন কাশ্মীরি পরিবারসহ শিবিরে আছেন। বাকি চার হাজার পণ্ডিত ভাড়াবাড়িতে থাকেন। সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া অসম্ভব ব্যাপার। তাই একমাত্র সমাধান হলো, সবাই মিলে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাওয়া।'' পণ্ডিতদের অভিযোগ, তারা জম্মু চলে যেতে চান। কিন্তু তাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না।
কাশ্মীরি পণ্ডিতরাই এখন অভিযোগ করছেন, বর্তমান সরকার পণ্ডিতদের কাশ্মীর-ত্যাগের দায় নিতে চায় না। তাই তাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। সেজন্যই শিবিরে কাশ্মীরিরা স্লোগান দিয়েছেন, 'প্রশাসন হায় হায়', 'সংখ্যালঘুদের বাঁচতে দাও', 'আমরা ন্যায় চাই' ইত্যাদি।
কাশ্মীরের সাংবাদিক রউফ ফিদার মতে, ''৩৭০ ধারা বিলোপের পর থেকে এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। একটা প্রচার শুরু হয়েছিল যে, কাশ্মীরে এবার অ-কাশ্মীরিদের নিয়ে গিয়ে বসানো হবে। সন্ত্রাসীরা এখন বোঝাতে চাইছে, বিষয়টি অত সহজ নয়।''
তার মতে, ''সরকার যে দাবি করে, কাশ্মীরে সব স্বাভাবিক, এই সব হত্যা, পণ্ডিতদের চলে যাওয়ার ঘোষণা, তার উল্টো ছবিটাই স্পষ্ট করছে।''