চীনের অনুরোধে কাশ্মীর নিয়ে আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ৷ কাশ্মীর এখনও স্বাভাবিক হয়নি, তা সত্ত্বেও বৈঠক নিয়ে ভারতে কোনও আশঙ্কা বা প্রত্যাশা কিছুই নেই৷
বিজ্ঞাপন
নরেন্দ্র মোদী সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপ ও কাশ্মীরকে আলাদা রাজ্য থেকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার কিছুদিনের মধ্যে প্রথমবার তা নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ৷ সেই বৈঠকে ভারত বিরোধী কোনও অবস্থান নেওয়া হয়নি৷ কাশ্মীর নিয়ে কোনও চাপের মুখেও পড়েনি নয়াদিল্লি৷ এখন আবার চীনের অনুরোধে দ্বিতীয় বৈঠক হচ্ছে৷ কাশ্মীর নিয়ে মোদীর সিদ্ধান্তের ১৩৩ দিন পরে৷ প্রায় সাড় চার মাস সময় কাশ্মীর কার্যত নিরাপত্তা রক্ষীদের বলয়ের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে আছে৷ টেলিফোন পরিষেবা চালু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইন্টারনেট নেই৷ কিছু স্কুল খুলেছে৷ কিছু নয়৷ আপেল বাগানে কাজ করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিক জঙ্গিদের হাতে মারা গিয়েছেন৷ কার্ফু নেই ঠিকই, কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীদের টহল আগের মতোই আছে৷
ইন্টারনেটহীন কাশ্মীরে ফিরছে পর্যটক
00:49
এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে কতটা লাভ হবে? প্রবীণ সাংবাদিক ও বিদেশ নীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা সাধারণত বাইরে বলা হয় না৷ তা ছাড়া আন্তর্জাতিক দুনিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় না কিছু হবে বলে৷ তাছাড়া কাশ্মীর নিয়ে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বার্থের ফারাক আছে৷ চীন অনেক বেশি করে লাদাখ নিয়ে উৎসাহী৷ তারা মনে করে, এখানে বিবাদিত ভূমি রয়েছে৷'' প্রণয় শর্মার মতে, আমেরিকার সংগঠন ছাড়া অন্য কোনও দেশ বা সংগঠনের তরফে কাশ্মীর নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি৷ তাঁদের প্রশ্ন নেই, এমন নয়, কিন্তু তা তারা প্রকাশ্যে বলছে না। একে ভারতীয় কূটনীতির সাফল্য বলা যায়৷
সাধারণত দেখা যায়, সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়, তারপরেই বিভিন্ন দেশ তার প্রতিক্রিয়া জানায়৷ এখন তো প্রায় সাড়ে ৪ মাস কেটে গিয়েছে৷ তাই চীন ও পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে এখন নতুন করে কোনও দেশের কাশ্মীর বিরোধিতার সম্ভাবনা কম৷ কাশ্মীরে গিয়ে তিনদিন থেকে এসেছেন সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা যোগেন্দ্র যাদব৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''মানবাধিকার নিয়ে চীনের রিপোর্ট যথেষ্ট খারাপ৷ তাই তারা কী বলছে তা নিয়ে আমি একেবারেই উৎসাহী নই৷ কাশ্মীরের বিষয়টি আমাদের দেশের ভিতরের লড়াই৷ আমাদের তা লড়তে হবে৷ কশ্মীরেতিনদিন থেকে মনে হয়েছে, সেখানে ভারতের পতাকাধারী যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও চুপ করে গিয়েছেন৷''
এই ভাবনার প্রতিধ্বনি দেখা যাচ্ছে, কাশ্মীরের প্রবীণ সাংবাদিক আলতাফ হুসেনের কথায়৷ ডয়চে ভেলেকে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আলতাফ বলেছেন, ''আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ওপরে কাশ্মীরের লোকের আস্থা নেই৷ কাশ্মীরের লোক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি নয়৷ তারা এটাও মনে করছে, যা করার নিজেদেরই করতে হবে৷''
তাই কাশ্মীরের লোক বা ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না, জাতিসংঘের বৈঠকের কোনও প্রভাব দিল্লির ওপর পড়বে৷
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।