মূল খবর থেকে সরে গিয়ে নাটকের এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। কাশ্মীরকে সামনে রেখে ক্রমাগত সেই কাজ করে চলেছে এক শ্রেণির মিডিয়া।
বিজ্ঞাপন
গত ২২ এ্রপ্রিল পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন মারা যান, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন পর্যটকছবি: Firdous Nazir/Nur Photo/IMAGO
বসে আছি আদিলের বাড়িতে। আদিল ঠোকার। পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় এই আদিল যুক্ত ছিল বলে সন্দেহ নিরাপত্তারক্ষীদের। শাস্তিস্বরূপ মাঝ রাতে আইইডি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি। প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে ওই ভাঙা বাড়ির দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে বসে আছেন আদিলের মা শাহজাদ। আর তাকে ঘিরে বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার। একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে। তাদেরই মধ্যে একজন আচমকা শাহজাদকে প্রশ্ন করে বসলেন, ''বাড়িটা যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আপনার কেমন লাগছিল?'' প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকা চোখটা একবার কেবল কেঁপে উঠল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে শাহজাদ বললেন, আদিল যদি সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে এই শাস্তি তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করছেন।
পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত সন্দেহে দুই যুবকের বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়ছবি: Basit Zargar/ZUMA Press/picture alliance
এরপর আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন শাহজাদ, কিন্তু তার আগেই মুহূর্তের মধ্যে শাহজাদের ওই কথাটি নিয়ে শুরু হয়ে গেল টেলিভিশন লাইভ। ঠিক যেমন হচ্ছিল আরেক আদিলের বাড়িতে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে পর্যটকদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন আদিল শাহ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার শরীর। লিডার নদীর ধারে আদিলদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে বসে আছেন তার বাবা। বাইরে মিডিয়া চ্যানেলের ভিড়। একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে যাচ্ছে সকলে, ''আদিলের মৃত্যুর পর ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে?'' একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন আদিলের বাবা-- ''দুখ ভি হ্যায়, ফকর ভি হ্যায়।'' ফকর, অর্থাৎ গর্ব। আর ওই একটিই বাক্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা দিন ধরে তার মুখ দিয়ে বলিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। আদিলের বাবা যতবার নিজের জন্য সময় চাইছেন, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ততই ঘিরে ধরছে তাকে। জাপটে ধরছে।
এই রিপোর্টাররাই এই মুহূর্তে গোটা কাশ্মীর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিয়মমাফিক দৈনিক কনভয়ের ছবি দেখিয়ে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করছেন। সেনা বাহিনীর বহু ব্যবহৃত ক্যান্টার দেখিয়ে বলছেন, আধুনিক ট্যাঙ্ক। ঝিলাম কিংবা সিন্ধ নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন সিন্ধু নদী। যে নদীর জলবন্টন এখন দুই দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের অন্যতম কারণ এখন। শুধু তা-ই নয়, সীমান্তে দাঁড়িয়ে ভুয়ো সংঘাতের গল্প শোনাচ্ছেন তারা।
কাশ্মীরে হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাড়তে থাকে উত্তেজনা৷ হামলার পর থেকে বিভিন্ন দেশের বাছাই করা প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই ছবিঘর...
ছবি: Tauseef Mustafa/AFP/Getty Images
পহেলগামে হামলায় নিহত ২৬
২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামের একটি পর্যটনকেন্দ্রে হামলায় ২৬ জন নিহত হন৷ আকস্মিক এই হামলার এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে৷ হামলার ঘটনার পর ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামের একটি জঙ্গি গোষ্ঠী এর দায় স্বীকার করে৷ ভারতের অভিযোগ, ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের’ সাথে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার যোগ রয়েছে৷
ছবি: ANI
ভারতের অভিযোগের আঙ্গুল পাকিস্তানের দিকে
ভারত মনে করে, সীমান্তের ওপাড় থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমকে মদত দিচ্ছে পাকিস্তান৷ এ অভিযোগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চুক্তি বাতিলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় তারা৷
ছবি: ANI
নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান পাকিস্তানের
হামলার ঘটনার পর দেশটির সেনেটে পাশ হওয়া এক রেজ্যুলেশনে সব ধরনের সন্ত্রাবাদী কার্যক্রমের নিন্দা জানায় পাকিস্তান৷ হামলার সাথে পাকিস্তানের যোগ রয়েছে- ভারতের এমন অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে এই বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায় দেশটি৷ ভারতের পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানও বেশ কিছু পালটা পদক্ষেপ নেয়৷
ছবি: Pakistan's Prime Minister Office/AP Photo/picture alliance
জাতিসংঘের নিন্দা
হামলার পর এক বিবৃতিতে এর নিন্দা জানায় জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে তার মুখপাত্র বলেন, ‘‘জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হাতহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছেন৷’’ কোনো পরিস্থিতিতেই সাধারণ মানুষের উপর হামলা গ্রহণযোগ্য নয়- জাতিসংঘের মহাসচিব তা মনে করেন বলেও তার মুখপাত্র জানান৷
কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে ঘটনার নিন্দা ও সমবেদনা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আপনারা জানেন, ভারতের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে৷’’ তিনি বলেন, ''তারা কোনো না কোনোভাবে একটি পথ খুঁজে নেবে৷’’ দুই দেশের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বানও জানায় হোয়াইট হাউস৷
ছবি: Jim Watson/AFP/Getty Images
হামলার নিন্দা চীনের, তদন্তের দাবিতে সমর্থন
হামলার ঘটনার পর এক বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুয়া জিয়াকুন বলেন, ‘‘চীন সব ধরনের সন্ত্রসবাদের বিরোধী৷’’ পাকিস্তানের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে চীন৷ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইসাক দারের সাথে ফোন কলে বলেন, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার সুরক্ষায় চীনের সমর্থন রয়েছে৷ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই কথা বলা হয়৷
ছবি: Kevin Frayer/Getty Images
জার্মানির তীব্র নিন্দা
হামলার ঘটনার পর জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আমরা পহেলগামে পযটকদের উপর বর্বর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই৷’’ বার্তায় শলৎস ভারতের জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন৷
ছবি: Stephanie Lecocq/REUTERS
মধ্যস্ততার প্রস্তাব ইরানের
পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে ইরান৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ফোন কলে হামলার নিন্দা জানান ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেসকিয়ান৷ এদিকে ভারত-পাকিস্তানের সাথে শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতার যোগসূত্রের উল্লেখ করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি উত্তেজনা নিরসনে মধ্যস্ততার প্রস্তাব দেন৷
পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক৷ প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান বলেন, ‘‘কাশ্মীর বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা খারাপ পরিস্থিতির দিকে মোড় নেওয়ার আগেই তা দ্রুত প্রশমিত হওয়া উচিত৷’’ এদিকে ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যমে তুরস্ক থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো হয়েছে- এমন প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়ে তুরস্ক সরকার জানায়, জ্বালানির নিতে একটি কার্গো বিমান পাকিস্তানে অবতরণ করেছিল৷
ছবি: Emin Sansar/Anadolu Agency/picture alliance
হামলার নিন্দায় আরো যেসব দেশ
হামলার ঘটনার দিনে সৌদি আরব সফরে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত দেশে ফেরেন তিনি৷ অন্যান্য দেশের মধ্যে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশও পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায়৷
ছবি: REUTERS
10 ছবি1 | 10
ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে পহেলগামে। কিন্তু ওই ঘটনা ঘিরে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ যা করছে, তা আরো ভয়াবহ। ভুয়ো খবরের বন্যা বইছে টেলিভিশন জুড়ে। অসত্য তথ্যের স্রোত বইছে সমাজ মাধ্যমে। যা দেখে মানুষ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।
আবার একটি ঘটনার কথায় ফিরে আসা যাক। উরি সেক্টরে লাইন অফ কন্ট্রোলের এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছানো গেছিল। ডয়চে ভেলে ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল আরো বেশ কিছু মিডিয়া। যার মধ্যে বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। উরি সেক্টরে প্রতিদিনই প্রায় গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু তা সীমান্ত পারাপার করছে না। এই ঘটনা সিস ফায়ার চুক্তি লঙ্ঘন করছে সন্দেহ নেই। তবে সীমান্তের মানুষ জানেন, কোন সংঘাত কেমন হয়। এখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নন। তাদের আশঙ্কা এমনটা যদি চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। শেলিং হলে তাদের বাড়ি ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও তাদের আছে। কিন্তু এখনো সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, প্রকাশ্যে বলছেন তারা। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ওই এলাকার কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন সীমান্ত পার করে গুলি এসে পড়ছে পায়ের গোড়ায়। চূড়ান্ত নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং করা হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে কার্যত ওই রিপোর্টিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
আবার এই রিপোর্টাররাই পহেলগামে ঘটনাস্থলের ছবি লাইভে দেখিয়ে দিচ্ছেন। দেখিয়ে দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর অভিযানের ছবি। এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২৬/১১ মুম্বই হামলার ঘটনা। লাইভ টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল এনএসজি অভিযানের ছবি। যে খবর সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছিল সন্ত্রাসীদের কাছে। ঠিক সেই একই কাণ্ড আবার ঘটতে দেখলাম পহেলগামে।
গণমাধ্যমের কাজ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু গণমাধ্যম যখন খবর তৈরি করতে শুরু করে, খবর তখন আর খবর থাকে না, নাটকে পরিণত হয়। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলির একটি বড় অংশ এখন ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। তৈরি হচ্ছে বিভেদ।
জনপ্রিয় কে না হতে চায়? কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, তা শুধু চিন্তার নয়, ভয়ের। আর এই ভয়ই ক্রমশ গ্রাস করছে ১৪০ কোটির একটি দেশকে। এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।