বেজিংয়ে ইমরান খানের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের দীর্ঘ বৈঠক। সামরিক সমঝোতার আলোচনা। কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব।
বিজ্ঞাপন
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তিত ভারত। এবার সেই সিপিইসি-তে আরো ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা জানালো চীন। এই করিডোরটিকে আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে। পাশাপাশি কাশ্মীর নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বস্তুত, শি জিনপিংয়ের কাছে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইমরান। রোববার ইমরান-শি-য়ের যৌথ বিবৃতি নিয়ে এখনো পর্যন্ত মুখ খোলেনি ভারত। তবে ভারত আগেই জানিয়ে দিয়েছিল কাশ্মীর এবং লাদাখ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্য কোনো দেশ সে বিষয়ে নাক গলাক, ভারত তা চায় না। সিপিইসি নিয়েও ভারত নিজের অবস্থান আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
ইমরান খানের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠক হওয়ার পর চীন সরকারিভাবে বিবৃতি জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, চীন এবং পাকিস্তান দুই দেশই চায় কাশ্মীর নিয়ে নানা স্তরে আলোচনা হোক। জাতিসংঘের চার্টার মেনে আলোচনার পরিবেশ তৈরি হোক। কাশ্মীর সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বার করা হোক।
অর্থ-বাণিজ্য-সমরে বন্ধু চীন-পাকিস্তান
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যত শীতল হোক না কেন, চীনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বরাবরই বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ৷ কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাতটা, বলা ভাল কূটনৈতিক বন্ধুত্বের শুরুটা কবে?
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schiefelbein
রাজনৈতিক সম্পর্ক
আলাপের সূত্রপাত ১৯৫১ সাল নাগাদ হলেও ১৯৬০-১৯৭০ সালের মাঝামাঝি দুই দেশের সম্পর্ক ভাল হতে শুরু করে ৷ চীন-পাকিস্তান পরস্পরের স্থায়ী সহযোগী হয় ঠিক সেই সময়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schiefelbein
ঐতিহাসিক চুক্তি
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের কিছুটা অংশ চীনের মানচিত্রে দেখা যায়৷ ১৯৬৩ সালে সীমানা সংক্রান্ত একটি চুক্তিও হয় তাদের মধ্যে ৷
ছবি: Vogel/Bläse
ভারত-পাকিস্তান বিবাদ
১৯৬৫ সালে ভারত-পাক বিবাদে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয় ৷ ১৯৬৫ সালে দুই দেশের পাঠ্যবইয়ে দুই দেশের নানা ঘটনা জায়গা পায়৷ সিনেমা প্রদর্শন ছাড়াও সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল অন্য ৷ পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যাদের বিমান সোজা বেইজিংয়ে যাতায়াত শুরু করে ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের সময় বিরোধিতা করেছিল চীন৷ ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্টের আগে বাংলাদেশকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেওয়ারও বিরোধী ছিল চীন ৷ পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সহায়তায় চীন সফরে যান বললে ভুল হবে না ৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
নিরাপত্তা সহায়তা
নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করতে থাকে চীন ৷ অন্যদিকে তাইওয়ান, তিব্বত, শিজিয়াং ও অন্য ইস্যুতে চীনকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করতে থাকে পাকিস্তান৷
ছবি: ISPR
অর্থনৈতিক সম্পর্ক
দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হয় ৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে পাকিস্তানেই৷ দু দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি৷ ২০০০-২০১৫ সালে বাণিজ্যিক চুক্তির পরিমাণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে৷
ছবি: picture-alliance/AA
সামরিক সম্পর্ক
সামরিক ক্ষেত্রেও যুযুধান দুই পক্ষের বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো৷ যৌথ মহড়া, অস্ত্র নির্মাণ, অফিসারদের প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাসদমনে পারস্পরিক সহায়তা সর্বত্র পাশে থেকেছে তারা ৷
ছবি: AP
ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাকিস্তানের শাহিন ক্ষেপণাস্ত্রের পিছনেও চীনের অবদান রয়েছে ৷ পাকিস্তানে বিমান বাহিনীতে চীনা প্রশিক্ষণ বিমান, চীনা রাডার সিস্টেমের ব্যবহার তো রয়েছে ৷ দুই দেশ একত্রে জেএফ-১৭-এর মতো যুদ্ধবিমান তৈরি করছে বলেও বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Naeem
পারমাণবিক প্রকল্প
পাকিস্তানের পরমাণু প্রকল্পকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে চীন৷ পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক কারখানা নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) ছাড়াও চীনের জাতীয় নিউক্লিয়ার কর্পোরেশনও সহায়তা করেছে ৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
অর্থনৈতিক করিডোর
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) তৈরিতে চীনের তরফে প্রায় ৫০ লাখ কোটি টাকা সহায়তার প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৷ এই প্রকল্পের অধীনে সড়ক, বিদ্যুৎ কারখানা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, বন্দর তৈরি হবে পাকিস্তানে ৷ বাড়বে কর্মসংস্থান ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. F. Röhrs
সাংস্কৃতিক সমঝোতা
ইসলামাবাদে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজের তরফে মিশবাখ রশিদ ডয়েচে ভেলেকে জানিয়েছিলেন চীনা ভাষা শেখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ৷ ২০০ থেকে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০০-এ ৷
ছবি: DW/S. M. Baloch
কাশ্মীর সংকট
কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও বারবার পাকিস্তানের পাশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থেকেছে চীন ৷ আকসাই চীন ইস্যুতেও চীনকে সমর্থন জানিয়েছে পাকিস্তান ৷
ছবি: Reuters/Handout
12 ছবি1 | 12
বস্তুত এর আগেও কাশ্মীর নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চীন এবং পাকিস্তান। ভারতের বিদেশমন্ত্রণালয় কড়া ভাষায় তার জবাব দিয়েছিল। ভারত জানিয়েছিল, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে অন্য কোনো দেশের সে বিষয়ে কথা বলার অধিকার নেই। শুধু তা-ই নয়, লাদাখ নিয়েও অন্য কোনো দেশ নাক গলাক, ভারত তা চায় না। বস্তুত, ভারতের বক্তব্য, পাকিস্তান কাশ্মীরের একটি অংশ 'দখল' করে রেখেছে। ভারত চায় সেখানে স্টেটাস কো বজায় থাকুক।
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর অর্থাৎ সিপিইসি পাকিস্তানের কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে গেছে। ভারতের তা নিয়ে তীব্র আপত্তি আছে। ওই অঞ্চলের ভিতর দিয়ে কোনো কিছুই ভারত বরদাস্ত করবে না বলে জানানো হয়েছে আগেই। এবার সেখানেই ৬০ বিলিয়ান ডলার খরচের কথা ঘোষণা করেছে চীন।
সম্প্রতি ভারতীয় পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, চীন এবং পাকিস্তান হাত মিলিয়ে ভারতকে 'ঘেরার' চেষ্টা করছে। ভারত সরকার এই বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। এর ফলে উপমহাদেশে ভারত একঘরে হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন রাহুল। রাহুলের ওই মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। বিজেপি রাহুলের বক্তব্যের সমালোচনা করেছিল। অ্যামেরিকাও জানিয়েছিল, রাহুল যেভাবে চীন এবং পাকিস্তানের প্রসঙ্গ এনেছেন, তা অভিপ্রেত নয়।
কিন্তু রাহুলের ওই বক্তৃতার কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তান এবং চীনের যৌথ বিবৃতি সামনে এলো। বিবৃতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সমঝোতার কথাও বলেছে চীন। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যেভাবে লড়াই করছে, তার প্রশংসা করেছে চীন। পাশাপাশি পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সিপিইসি-র কাজ করতে গিয়ে বেশকিছু চীনা কর্মী পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তান জানিয়েছে ভবিষ্যতে যাতে এমন না হয়, সে দিকে নজর রাখা হবে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, পাকিস্তান এবং চীন যেভাবে যৌথ বিবৃতি পেশ করেছে, উপমহাদেশের কূটনীতিতে তা যথেষ্ট প্রবাব ফেলতে পারে।