কাশ্মীর প্রশ্নে আরব বন্ধুদের হারানোর ঝুঁকিতে পাকিস্তান
২৪ আগস্ট ২০২০
আরব দেশগুলো সরাসরি পাশে না দাঁড়ানোয় কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে এখন নতুন মিত্র খুঁজছে পাকিস্তান৷ আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কও আপাতত নড়বড়ে৷
বিজ্ঞাপন
এ মাসের শুরুর দিকে ৫৭ জাতির ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি-র সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি বলেন, ‘‘আমি ওআইসি-কে আবার বলছি, আমরা চাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটা সম্মেলন হোক৷ আপনাদের পক্ষে তা সম্ভব না হলে কাশ্মীর প্রশ্নে যে দেশগুলো পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হবো৷’’
এমন মন্তব্যে অবশ্য পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধা হয়নি৷ বরং ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষুব্ধ হয়েছে সৌদি আরব এবং তাই ইতিমধ্যে তেল ঋণ সংক্রান্ত ৩২ লাখ ডলারের অফার স্থগিত করে আগের পাওনা ৩০০ কোটি ডলার পরিশোধের জন্য চাপও দিতে শুরু করেছে পাকিস্তানকে৷
দেশভাগের আগুন, যা এখনো জ্বলছে
১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল৷ হিন্দু অধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান৷ সেই থেকে দুই দেশের কিছু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়া কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং শত্রুতা বেড়েই চলেছে৷
ছবি: AP
দুই দেশের জন্ম
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই দেশে বিভক্ত হয়৷ জন্ম নেয় নতুন দুই রাষ্ট্র৷ ভারত ও পাকিস্তান৷ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রথমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উপর নিজেদের আধিপত্য দাবি করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান৷ জিন্নাহ’র বিশ্বাস ছিল হিন্দু আর মুসলিমরা ভবিষ্যতে একসাথে থাকতে পারবে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/United Archives/WHA
রক্তাক্ত পথ
পার্টিশন বা দেশ বিভাগ নৃশংস এবং ভয়াবহ এক অধ্যায়ের নাম৷ ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে৷ ইতিহাসবিদরা বলেন, ঐ দাঙ্গায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ জন্মভূমি ছেড়ে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে লাখ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Images
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কাশ্মীর নিয়ে আবারো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল হিন্দু নেতার হাতে৷ কিন্তু জিন্নাহ চাইলেন এটা যাতে পাকিস্তানের অধীন হয়৷ ১৯৪৮ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ কাশ্মীর উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনারা৷ কিন্তু সেই সংঘর্ষের জের অব্যাহত আছে আজও৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো
উদারপন্থি ইতিহাসবিদরা বলেন, জিন্নাহ এবং মহাত্মা গান্ধী নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন চেয়েছিলেন৷ জিন্নাহ’র আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো সম্পর্ক হবে ভারত-পাকিস্তানের৷ কিন্তু ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা নতুন দিল্লির সঙ্গে বিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: AP
উপস্থাপনের ভিন্নতা
ভারত ও পাকিস্তান সরকার দেশভাগের ব্যাপারটিকে একেবারে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে৷ ভারত এটাকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করে, যেখানে মহাত্মা গান্ধীকে এর স্থপতি বলা হয়৷ অন্যদিকে, পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুক্তির আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৪ আগস্টকে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
সম্পর্কের টানা-পোড়েন
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গত সাত দশক ধরেই তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ আর গত কয়েক বছর ধরে ইসলামি জঙ্গিবাদের কারণে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে৷ নয়া দিল্লি বরাবরই পাকিস্তানকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদে মদদদাতা হিসেবে দায়ী করে আসছে৷ আর ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে৷
ছবি: Picture alliance/AP Photo/D. Yasin
6 ছবি1 | 6
তবে পরিস্থিতি যে ভালো নয় তা বুঝতে পেরেছে ইমরান খান সরকার৷ দৈনিক ডনসহ পাকিস্তানের গণমাধ্যমের একাংশ মনে করে, পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়াকে রিয়াদে পাঠানো হয়েছে৷
কাশ্মীর প্রশ্নে কী চায় পাকিস্তান?
ওয়াশিংটন ভিত্তিক উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্স -এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মিশায়েল কুগালমান মনে করেন, কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান বহির্বিশ্বে যেমন সমর্থন আশা করেছিল তা একেবারেই পায়নি৷ অন্যদিকে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কিছু কাজের সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বিশেষ করে জম্মু এবং কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র উন্মোচনের মাঝে দেশে সাধারণ মানুষের সাময়িক হাততালি ছাড়া আর কিছু প্রাপ্তির আশা নেই বলেও মনে করেন তারা৷
কে আছে, কে নেই?
ইসলামাবাদের কায়েদ-এ আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক রাজা কায়সার আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে কাশ্মীর প্রশ্নে আক্রমণাত্মক কূটনীতিতে আস্থা রাখা উচিত পাকিস্তানের৷ অথচ এ সময়েও চীন, মালয়েশিয়া আর তুরস্ক ছাড়া আরো কাউকে পাশে পাচ্ছে না পাকিস্তান৷ বরং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ভালি নাসির মনে করেন, সৌদি আরবের কাছে ভারত হলো বড় এক বাণিজ্যিক বন্ধু, ফলে তারা চায় না দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক৷
হারুন জানজুয়া/ এসিবি
৪ মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...
এশিয়ার মানচিত্রের যত রাজনীতি
এক দেশ থেকে আরেক দেশে বদলে যায় একই ভূখণ্ডের মানচিত্র৷ এশিয়ায় কেমন এই মানচিত্রের রাজনীতি, দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/AFP/F. J. Brown
সরকারের যত কড়াকড়ি
ভারতের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, উত্তর ভারতের অভিন্ন অঙ্গ জম্মু ও কাশ্মীর৷ তাই সেদেশের মানচিত্রে পাকিস্তান ও চীন নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকেও ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হয়৷ শুধু তাই নয়, ভারতে সরকার অনুমোদিত নকশা ছাড়া কাশ্মীরের অন্য সব মানচিত্র অবৈধ৷
পাকিস্তান যা বলছে
পাকিস্তানেও কাশ্মীরের মানচিত্র বেশ স্পর্শকাতর একটি বিষয়৷ কিন্তু ভারতের মতো সেখানে গোটা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে দেখানো হয়না৷ এর বদলে মানচিত্রে কাশ্মীরের কিছু অংশের গায়ে ‘বিতর্কিত অংশ’ বা ‘অনির্দিষ্ট সীমান্ত’ লেখা থাকে৷
সরকারি মানচিত্র কতটা সঠিক?
জাতিসংঘের বৈশ্বিক জিওস্প্যাশিয়াল তথ্যবিষয়ক কমিটির প্রধান টিম ট্রেনর বলেন, ‘‘মানচিত্রের ক্ষমতা অনেক৷ একটি মানচিত্র দেখলেই আমরা ভেবে নিই যে তা আসলে সঠিক তথ্য দিচ্ছে৷’’ তাঁর মতে, মানচিত্র বিশ্বের মানুষের চিন্তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে৷ তিনি আরো বলেন যে, এশিয়ার অনেক দেশের সরকারি মানচিত্রের সাথে সত্যের খুব কমই মিল আছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. J. Brown
দক্ষিণ চীন সাগরের উদাহরণ
২০১৯ সালের ‘এবোমিনেবল’ ছবিতে একটি বিশেষ মানচিত্র দেখানোর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের দখল নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ সেই মানচিত্রে তাইওয়ান ও গোটা দক্ষিণ চীন সাগরকে চীনের অংশ হিসাবে দেখানো হয়৷ যদিও আন্তর্জাতিক মহলে এই অঞ্চলের ওপর মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, ব্রুনেই, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান প্রভৃতি দেশের দাবি রয়েছে৷
মানচিত্র বিশেষজ্ঞ টিম ট্রেনর বলেন, যে কোনো মানচিত্রকে সঠিক ধরে নেবার আগে প্রশ্ন করতে হবে যে সেই মানচিত্রের কাজটা ঠিক কী, আর কারাই বা তৈরি করেছে সেই মানচিত্র৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো মানচিত্রের একটি মাত্র নির্দিষ্ট নকশা থাকতে পারেনা৷’’ তাঁর মতে, ভালো মানচিত্র সেটাই যেখানে তথ্যের সূত্র ও তথ্যপ্রাপ্তির তারিখ দেওয়া থাকে৷ পাশাপাশি, বিতর্কিত সীমান্তের উল্লেখও থাকা উচিত৷
ছবি: Public Domain
অবস্থান অনুযায়ী বদলায় মানচিত্র
বিশ্বের বেশিরভাগ গবেষক ও সাধারণ নাগরিক মানচিত্র বিষয়ে ধারণা পেতে গুগল ম্যাপস বা গুগল আর্থ-এর মতো অ্যাপের ওপর নির্ভর করেন৷ কিন্তু ডয়চে ভেলেকে গুগল জানিয়েছে, অ্যাপ ব্যবহারকারী কোন মানচিত্র দেখতে পাবেন তা তার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে৷ যেমন ভারতের বাসিন্দারা ভারত সরকার অনুমোদিত মানচিত্রই দেখতে পান৷ কিন্তু কেন অন্যান্য মানচিত্রের তথ্য দেয়না গুগল, সেবিষয়ে তাঁরা কিছু বলেনি৷
ছবি: Knight-Mozilla-MIT “The Open Internet” Hack Day/opennews.kzhu.io