১৯৪৭ সালে ভারতের অংশ হবার পর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জন্য বরাদ্দ ছিল সংবিধানসম্মত ‘বিশেষ মর্যাদা'৷ সোমবার রাজ্যসভায় এই মর্যাদা সরিয়ে নেবার প্রস্তাব পাশ হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের বদলে স্বাধীন ভারতের অংশ হতে দিতে রাজি হন তৎকালীন কাশ্মীরের রাজা হরিসিং৷ নতুন রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ হলেও ভারতীয় সংবিধানে তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ‘বিশেষ মর্যাদা'৷ এতদিন পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শীর্ষ ক্ষমতা থাকতো রাজ্য সরকার ও বিধানসভার হাতে৷ সেখানে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কোনো স্থান ছিল না৷
কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলিতে হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতানৈক্যের কারণ৷ বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি জন্মলগ্ন থেকে ছিল এই বিশেষ বিধানের বিপক্ষে৷ উল্টোদিকে কংগ্রেস ও বামপন্থি দলগুলির বেশির ভাগই ছিল কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্ত শাসনের পক্ষে৷
সংবিধান কার্যকর হবার ৬৯ বছর পর সোমবার লোকসভায় একটি প্রস্তাব পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ৷ সেখানে সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবসানের দাবি তোলেন তিনি৷ বর্তমান সংসদে ভারতীয় জনতা পার্টির সবচেয়ে বেশি সদস্য থাকার ফলে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পায় এই বিল৷ একই দিনে তাতে স্বাক্ষর করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' এখন আইনত বাতিল হবার পথে৷
কাশ্মীর নিয়ে কে কী বলছেন
সোমবার ভারতের রাজ্যসভায় বিল পাস হওয়ার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর হারাতে চলেছে তার সাংবিধানিক ‘বিশেষ মর্যাদা’৷ এর প্রতিক্রিয়া কোথায় কেমন, জানুন ছবিঘরে...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
ওমর আবদুল্লাহ, জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী
ওমর আবদুল্লাহসহ একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বর্তমানে গৃহবন্দি৷ রাজ্যসভায় সদ্য পাস হওয়া বিল প্রসঙ্গে ওমর আব্দুল্লাহ বেশ কয়েকটি টুইট করেন৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘সরকারের এই পদক্ষেপ কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ করেছে৷ এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/T. Mustafa
মেহবুবা মুফতি, জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী
মেহবুবা মুফতিও এখন গৃহবন্দি৷ এই পদক্ষেপের চরম বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান এভাবে বদলানো মানে কাশ্মীরের জনগণকে ক্ষমতাচ্যূত করা৷ শুধু তাই নয়, অটলবিহারি বাজপেয়ী কাশ্মীরের মানুষের কথা শুনে তারপর সিদ্ধান্তে আসার যে ধারা চালু করেছিলেন, মোদী সরকার সেই ধারাকে অসম্মান করেছে৷’’
ছবি: Imago/Hindustan Times
গুলাম নবি আজাদ, কংগ্রেস নেতা
রাজ্যসভা, যেখানে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে নেবার প্রস্তাব পেশ করা হয়, সেখানে কংগ্রেসের বরিষ্ঠ সদস্য গুলাম নবি আজাদ এই বিলকে ‘ভারতের সংবিধানকে খুন’ করার সাথে তুলনা করেন৷ একই সুর শোনা যায় সিপিআই, সিপিআই (এম) নেতৃত্বের বক্তব্যেও৷
ছবি: AP
অরবিন্দ কেজরিওয়াল, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী
আম আদমি পার্টির নেতা ও দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এমনিতে বিজেপি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের চরম সমালোচক৷ কিন্তু কাশ্মীর বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি৷ তিনি আশা করেন যে এই পদক্ষেপের ফলে কাশ্মীরের মানুষ শান্তি ফিরে পাবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
পক্ষে যে যে দল
স্বাভাবিকভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রস্তাবিত এই বিলের পাশে ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ ও তাদের জোটসঙ্গীরা৷ বর্তমানে বিজেপির জোটসঙ্গি দলগুলি হলো টিআরএস, শিবসেনা, বিএসপি, এআইএডিএমকে ও টিডিপি৷ কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে আম আদমি পার্টিও৷
ছবি: Reuters
বিপক্ষে যে যে দল
ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধীর আসনে বসেন কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে ও সিপিআই (এম)সহ বামপন্থি দলের সদস্যরা৷ এই দলের সাংসদরা রাজ্যসভা উত্তাল করে তোলেন কাশ্মীরের মর্যাদা বদলের এই বিল পাশ হওয়ার প্রতিবাদে৷
ছবি: DW/P. Mani
কাশ্মীরের দলগুলি যা বলল
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল পিডিপি অর্থাৎ পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি৷ সেই দলের সদস্যরা রাজ্যসভায় বিল পেশ করার মূহুর্তে ব্যাপক প্রতিবাদ করেন৷ প্রতিবাদস্বরূপ দুই সাংসদ ফৈয়াজ আহমেদ মীর ও নাজির আহমেদ ভারতের সংবিধান ছিঁড়ে ফেলেন রাজ্যসভায়৷ তখন তাদের বেরিয়ে যেতে বলেন রাজ্যসভার স্পিকার ভেঙ্কাইয়া নাইডু৷ পরে তারা সংসদের বাইরে প্রতিবাদ করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি
কাশ্মীরের মর্যাদা বদলের বিল পাশ হওয়া ঘিরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে৷ পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপি’র চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি একটি টুইটে বলেন, ‘‘এই পদক্ষেপের ফলে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে বর্তমান ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা পরিষ্কার হয়েছে৷’’
ছবি: DW/Shamil Shams
পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রণালয় যা বলল
রাজ্যসভায় সোমবার বিল পাস হবার পর থেকেই পাকিস্তানের সরকার নড়েচড়ে বসে৷ বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ‘‘এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তান ও ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের জনতা কখনোই মেনে নেবে না৷ এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে রয়েছে৷ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যথাযথ ব্যবস্থা নেবে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/A. Shahid
9 ছবি1 | 9
শুধু ‘মর্যাদা'-ছিন্নই নয়, জম্মু ও কাশ্মীর হারাতে চলেছে রাজ্যের মানও৷ পাস হওয়া বিল অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীর ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা ‘ইউনিয়ন টেরিটোরি' করা হবে যথাক্রমে লাদাখ ও জম্মু ও কাশ্মীর নামে৷ উল্লেখ্য, ভারতের আইন অনুযায়ী, রাজ্যের তুলনায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পরিচালনায় কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতা থাকে অনেকটাই বেশি৷
বিভক্ত বিরোধী পক্ষ, সংবাদমাধ্যম
এই বিলটি লোকসভায় পেশ করা হলে তা ‘ভারতীয় সংবিধানকে খুন করার সমান' বলেন রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ৷ অন্যদিকে, বিজেপির জোটসঙ্গী দল পিডিপি'র সদস্য ও জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি একটি টুইটে জানান, ‘‘আমরা যারা গণতন্ত্রে আস্থা রাখতাম, তাদের ঠকানো হয়েছে৷ এতে করে কাশ্মীরের জনতা ভারতীয় সংবিধানের প্রতি আস্থা আরো বেশি হারাবে৷''
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহ থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হয়তো কেড়ে নেওয়া হবে৷ এর ফলে সেখানে তৈরি হতে পারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, আঁচ করছিলেন সরকারসহ অনেকেই৷ সে-কারণেই, রোববার ৫,০০০ ব্যাটেলিয়ন সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়, জারি করা হয় ১৪৪ ধারা৷ পাশাপাশি মুফতিসহ একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন গৃহবন্দি৷
কাশ্মীরকে ঘিরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও বিভক্তি চোখে পড়ছে৷ এক অংশ যদিও এই বদলকে দেখছেন ভারতের বহু প্রতীক্ষিত জয় হিসাবে, আরেক অংশে সরকারের সমালোচনা করছেন মিডিয়ার বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব৷ বর্তমানে টুইটার সরগরম কাশ্মীরের খবরেই৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, কাশ্মীরে ছিন্ন রয়েছে ইন্টারনেট ও টেলিফোন পরিষেবা৷ ফলে এখনই মাঠপর্যায়ের খবর পাওয়া দুষ্কর৷