শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর মরদেহ শনিবার দাহ করা হয়েছে৷ অবিসংবাদিত এই নেতার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিউবাবাসী৷ নয়দিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে৷
বিজ্ঞাপন
হাভানা একটি প্রাণবন্ত শহর৷ কিন্তু কাস্ত্রোর মৃত্যুতে এই শহরটিরও যেন মৃত্যু হয়েছে৷ চারদিকে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা৷ বন্ধ আছে মদ্যপান ও বিক্রি৷ বিভিন্ন বিনোদন অনুষ্ঠান ও জনপ্রিয় বেসবল ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে৷ মাত্র ৩২ বছর বয়সে ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতা গ্রহণ করে টানা অর্ধশত বছর ধরে নিজের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে গেছেন৷
যার শ্লোগান ছিল ‘সমাজতন্ত্র, নয়ত মৃত্যু'৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হৃদয়ে এই ধারণাই পোষণ করে গেছেন তিনি৷ কমিউনিস্ট ও পুঁজিবাদী শিবিরে বিভক্ত গত শতকের বিশ্বে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের এক প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো৷ শুক্রবার রাতে কাস্ত্রোর মৃত্যুর খবর ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই রাজধানী হাভানার রাস্তাগুলো নীরব হয়ে আছে৷ শোকের এই পরিবেশে ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সাপ্তাহিক প্রতিবাদ মিছিল বন্ধ রেখেছে কিউবার সবচেয়ে পরিচিত ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী৷
এখন দেহভস্ম একটি শবাধারে রাখা হয়েছে৷ সোমবার থেকে দু'দিনের শোকসভায় বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতারা যোগ দেবেন৷ শ্রদ্ধা জানাবেন তার দেহভস্মে৷ সবার শ্রদ্ধা জানানো শেষে ৩০ নভেম্বর ১৯৫৯ সালের বিপ্লবে ফিদেলের গেরিলা বাহিনী যে পথে হাভানা পৌঁছেছিল, তাঁর উল্টোপথ অনুসরণ করবে দেহভস্ম৷
এভাবে সেটা সান্তিয়াগো দ্য কিউবা শহরে গিয়ে পৌঁছাবে৷ ১৯৫০-এর দশকে পূর্বাঞ্চলীয় এই শহরটি থেকেই বিপ্লব শুরু করেছিলেন ফিদেল৷ ৪ ডিসেম্বর সেখানেই তাঁর রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টি শেষে দেহভস্ম সমাহিত করা হবে৷ এর মাধ্যমে নয় দিনের রাষ্ট্রীয় শোক শেষ হবে৷ ওই দিন হাভানার রেভোল্যুশন স্কয়ারে আরেকটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে৷ বিদেশি বিশিষ্ট অতিথিরা যোগ দেবেন এ অনুষ্ঠানে৷
জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনে টাঙানো হয়েছে কাস্ত্রোর বিশাল প্রতিকৃতি৷ প্রতিকৃতি টাঙানোর সময় এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘তিনি ছিলেন আমাদের জন্য সব৷ তাই তাঁর মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন একজনও খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷'' মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা, কমিউনিস্ট নেতারা প্রয়াত ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন৷ এরপর রাতে শ্রদ্ধা জানাবেন বিশ্ব নেতারা৷
১৯৬১ সালে তাকে হত্যা পরিকল্পনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বে অফ পিগস৷ তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ সারা জীবনে তাঁর উপর ৬০০-রও বেশি গুপ্তহত্যা চেষ্টা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা এএফপি৷
উত্তর কোরিয়ায় শোক পালন
কাস্ত্রোর মৃত্যুতে সোমবার থেকে তিনদিনের আনুষ্ঠানিক শোক পালন শুরু করেছে উত্তর কোরিয়া৷ দেশটি মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে কাস্ত্রোকে৷ সরকারি ভবনগুলোতে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে৷ এছাড়া বিভিন্ন ট্রেন ও মেট্রো স্টেশনে কাস্ত্রোর সামরিক পোশাক পরা কালো ফ্রেমবন্দি ছবি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়েছে৷
ফ্লোরিডায় উৎসবের আমেজ
ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুতে উল্লাসে মেতে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কিউবার ভিন্নমতাবলম্বী নির্বাসিত লোকজন৷ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০ লাখ কিউবান নাগরিকের বাস৷ এর মধ্যে ৭০ শতাংশই থাকে ফ্লোরিডায়৷
এই অঙ্গরাজ্যের মায়ামি শহরে গতকালও তারা আনন্দে মেতে থাকে৷ ফিদেলের মৃত্যুসংবাদ প্রচার হওয়ার পরপরই গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কিউবানরা উল্লাস করতে করতে সড়কে নেমে যায়৷
এপিবি/এসিবি (এপি, এএফপি, ডিপিএ, রয়টার্স)
বিপ্লবের মহানায়ক ও ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ ফিদেল কাস্ত্রো
কিউবা বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ফিদোল কাস্ত্রো আর নেই৷ ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ‘বাংলাদেশে বন্ধু’ কাস্ত্রো৷ ছবিঘরে তাঁরই কিছু কথা ও ছবি...
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Garcia Mederos
এই তো সেদিন...
গত ১৩ আগস্টই তাঁর জন্মদিন উদযাপন করেছিল কিউবা৷ তাই হাভানার রাস্তার ধারের দোকানটির এই জানালাতেও ছিল তাঁর জন্য শুভকামনা, সেখানে লেখা, ‘ফিদেলের ৯০ এবং আরো অনেক দিন...৷’’ কিন্তু অনেকদিন নয়, মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই চিরবিদায় নিলেন কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ৷ কিউবার সময় অনুযায়ী শুক্রবার রাতে রাজধানী হাভানায় প্রয়াণ হয়েছে তাঁর৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Lage
কিউবার অন্য নাম ‘কাস্ত্রোর দেশ’
১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাস্ত্রো৷ তারপর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন প্রেসিডেন্ট৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে৷ কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্বের শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের পাশেই তাঁর নেতৃত্বে কিউবা এখনো অটল৷ ২০০৮ সালে রাষ্ট্র শাসনের ভার ভাই রাউল কাস্ত্রোকে দিয়ে অবসর জীবনই যাপন করছিলেন কাস্ত্রো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Ernesto
যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ ছিলেন না
তাঁর নেতৃত্বে পথ চলতে শুরু করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকায় পায়নি কিউবা৷ ১৯৬১ সালে সম্পর্ক ছিন্ন করে কিউবার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে বৈরিতা৷ ওবামা দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগ নেন৷ তারই ফলশ্রুতিতে গত মার্চে কিউবা সফর করেন ওবামা৷ওপরের ছবিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট রৌহানির সঙ্গে কাস্ত্রো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Castro
যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অমর বাণী
ওবামার কিউবা সফরের আগে থেকেই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক নিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগে কাস্ত্রোর করা এক মন্তব্য নিয়ে চলছিল ব্যাপক আলোচনা৷ কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এলে এবং লাতিন আমেরিকার কেউ পোপ হলে যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই কিউবার সঙ্গে আলোচনার জন্য এগিয়ে আসবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Ernesto
ক্রীড়াপ্রেমী এবং মারাদোনার বন্ধু
খেলাধুলায় বেশি ঝোঁক থাকার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কখনো বেশি মনযোগী হতে পারেননি ফিদেল কাস্ত্রো৷ পরে সাম্যবাদ কায়েমের স্বপ্ন তো আইন বিষয় নিয়ে লেখাপড়াও শেষ করতে দেয়নি৷ ফুটবল ভালোবাসতেন৷ সেই সুবাদে দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক৷ একবার মারাদোনা ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তাঁকে কিউবায় ডেকে নেন কাস্ত্রো৷ সুস্থ হয়েই দেশে ফিলেছিলেন মারাদোনা৷
ছবি: AP
বাংলাদেশের বন্ধু
একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালিদের পাশে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো৷ তার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়৷ কাস্ত্রোর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শোক বার্তায় বলেছেন, ‘‘ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি৷ শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রামের কথা বিশ্ববাসী আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Garcia Mederos
কাস্ত্রোর হিমালয় ‘বঙ্গবন্ধু’
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর৷ বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে কাস্ত্রো সেদিন বলেছিলেন, ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি৷ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় এই মানুষটি হিমালয়ের মতো৷ আজ যেন আমার কাছ থেকে হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা হলো৷’’