কিছুর লাভ, লোভ এবং অনেকের দুর্ভোগের যে জনপ্রিয়তা
২৫ আগস্ট ২০২৩সম্প্রতি স্কুল-শিক্ষার্থীদের গালাগাল করে ‘ভাইরাল ভিডিও' তৈরি এমন প্রবণতাকে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷
টিকটক, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো মাধ্যমে অল্প সময়ে ‘ভাইরাল' হতে গিয়ে উদ্ভট সব কাজ করছেন অনেকে। কেউ কেউ অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিমেষে৷ তারপর তাদের কেউ কেউ হারিয়েও যাচ্ছেন৷ তবে রেখে যাচ্ছেন সহজে ভাইরাল বা খবরের শিরোনাম হওয়ার ‘ফর্মুলা'৷ এমন করতে গিয়ে নিজের বিপদও ডেকে আনছেন কেউ কেউ। পড়ছেন আইনি ঝামেলায়।
সম্প্রতি কুমিল্লায় স্কুল ছাত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে টিকটক ভিডিও বানিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন দুই টিকটকার। এর আগে পার্কে বেড়াতে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়েও ভিডিও করে ‘ভিউ' কামিয়েছেন কিছু টিকটিকার।
কথিত এই ‘সস্তা জনপ্রিয়তা'র পেছনে বিভিন্ন পেশার মানুষকেই ছুটতে দেখা যাচ্ছে৷
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে প্রাঙ্ক ভিডিও বানানোর হিড়িক একরকম অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভিডিও বানিয়ে তা টিকটক, ইউটিউব বা ফেসবুকে ছাড়ছেন তারা। এমন ঘটনা নিয়ে থানায় অভিযোগ এবং মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।
টিকটকাররা বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে। ২০২০ সালের আগষ্টে উত্তরায় রাস্তা বন্ধ করে টিকটক করতে দিয়ে গ্রেপ্তার হন টিকটকার ‘অপু ভাই'। রাস্তা বন্ধ করায় এলাকাবাসী বাধা দিলে তিনি দলবল নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন।
চলতি বছরের জুলাই মাসে পুলিশকে নিয়ে টিকটক ভিডিও বানানোর অভিযোগে রাজশাহীতে গ্রেপ্তার হন ছয় টিকটকার।
অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন অনেক টিকটকার। গত জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে এক স্কুল ছাত্রীকে অপহরণের অভিযোগে তিন টিকটকারকে আটক করে পুলিশ। টিকটক সূত্রেই ওই স্কুল ছাত্রীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছিল। গত বছরের আগষ্টে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে এক টিকটকারকে আটক করা হয় ব্ল্যামেইলিংয়ের অভিযোগে। তিনি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় এক স্কুল ছাত্রীর ব্যক্তিগত দৃশ্য গোপনে ধারণ করে তা দিয়ে টিকটক ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
টিকটকারদের দেশের বাইরে আটক হওয়ার নজিরও আছে। গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি কুয়েতের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের গাড়িতে পানি ভর্তি বেলুন ছুড়ে মেরে ভিডিও ধারণ করেন বাংলাদেশি এক টিকটকার। সেই ভিডিও টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি। ভিডিওটি ভাইরাল হলে স্থানীয় পুলিশের নজরে আসে। পরে সেই বাংলাদেশি যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আফতাব হোসেন। তিনি তার পিএইচডি গবেষণা করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্যবহারকারীদের আচরণ নিয়ে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে টেলিভিশনে অডিশনের বিষয় আছে। তাই কেউ কিছু করতে চাইলে তাকে সেটা পার হয়ে করতে হয়। সেখানে গেট কিপিং আছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই গেটকিপিং নেই। ফলে এটা ব্যবহার করে অনেকেই জনপ্রিয় হতে চায়। আবার ব্যবহারকারীরা কখনো কখনো ট্রল করে তাকে ভাইরালও করে দেয়। ফলে তিনি মনে করেন তিনি হিরো হয়েছেন। কিন্তু আসলেই কি তিনি হিরো?”
তার কথা, "এখানে যে প্রবণতা, তা হলো, কোনো কষ্ট বা পরিশ্রম না করেই অনেকে অস্বাভাবিক কিছু করে সেলিব্রিটি হতে চান। এর সাথে আর্থিক দিকও আছে। অনেক লাইক, ফলোয়ার হলে অর্থও আয় হয়। তখন সে আর ভাবে না কখন কী করছে। চাহিদা আছে তাই সে করে।”
"এর বিপজ্জনক দিক হলো, আমাদের আপকামিং জেনারেশন মিসগাইডেড হয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করছে এভাবেই বুঝি সেলিব্রিটি বা জনপ্রিয় হওয়া যায়। তারা বুঝতে পারে না এই সস্তা জনপ্রিয়তা যে আসল জনপ্রিয়তা নয়,” বলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের চেয়ারম্যান। যারা সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে চান তারা এটা করতে গিয়ে সামাজিকসহ ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েন বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, "একটি বাচ্চাকে মেরে তার ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া, ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার মতো অমানবিক ও বোআইনি ঘটনাও এখানে ঘটেছে।” তার মতে এর জন্য সবার আগে দরকার সোশ্যাল মিডিয়া লিটারেসি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন," আমরা প্রতিদিনই সাইবার অপরাধের নানা অভিযোগ পাই। আর এই অভিযোগের শতকরা ৩০ ভাগ টিকটকারদের বিরুদ্ধে। তারা মূলত সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে নানা ধরনের অস্বাভাবিক ভিডিওতৈরি করে। আবার এটা করতে গিয়ে নানা অপরাধও করে।এদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।”
এর বিপদ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এর দুই ধরনের বিপদ আছে। প্রথমত, এই টিকটকার বা যারা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একইরকম সক্রিয়, তারা নিজেরাই টার্গেটে পরিণত হতে পারেন। তাকে নিয়েই আরেক গ্রুপ নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে পারে, তাকে ব্যবহারও করতে পারে, যা তার নিরাপত্তার সংকট তৈরি করে। আবার টিকটাকাররাও বেশি জনপ্রিয়তা পেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তারা এমন কোনো ভিডিও ধারণ করতে পারে, যা বেআইনি। এমন কোনো দৃশ্য তৈরি করতে পারে, যা ক্ষতিকর। আবার তাদের ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি দেশের প্রচললিত আইনে অপরাধমূলকও হতে পারে। এছাড়া তাদের এইসব কাজ অন্যের ক্ষতির কারণও হতে পারে।”
" তাই তারা যা-ই করুন না কেন, বুঝে করতে হবে। আইন মেনে করতে হবে। পরিবার ও সমাজের রীতিনীতি বুঝতে হবে। সেটা না বুঝে,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রচারমাধ্যম ব্যবহারের এই প্রবণতা নিজের সম্পর্কে আস্থাহীনতা থেকে তৈরি হয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, "যারা হীনমন্যতায় ভোগেন, নিজ পেশায় বা নিজ অবস্থানে যখন কেউ নিজের সম্পর্কে আস্থাশীল থাকেন না, তখন গুরুত্ব পেতে এই প্রক্রিয়া বেছে নেন।”
"তিনি চান সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তাই এমন অস্বাভাবিক কিছু করেন যার মাধ্যমে তিনি খুব দ্রুত পরিচিতি পেতে পারেন। এটা একটা মানসিক অস্বাভাবিক অবস্থা। আর কেউ কেউ এটা করে পরিচিতি পাওয়ায় অন্যরা মনে করেন তারাও ওইভাবে পরিচিত হবেন,” বলেন এই চিবিৎসক।
তার কথা, এর জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা এবং নির্দেশনা। আর জনপ্রিয়তা যে হঠাৎ পাওয়ার বিষয় নয় সেটাও বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জনপ্রিয় হওয়া আর সবার চোখে খেলো হওয়া- এক জিনিস নয়। অনেক লোক একজনকে চেনেন এবং তাকে নিয়ে মজা করেন- এটা কোনো জনপ্রিয়তা নয়।
তিনি বলেন, "সস্তা জনপ্রিয়তার এই প্রবণতায় যারা ভোগেন, তারা নিজেরা বিপদে পড়েন, অন্যেরও ক্ষতি করেন।”