করোনা মহামারির সময় কিছু মানুষ বাকিদের তুলনায় সহজে সংক্রমিত হননি৷ গবেষকরা ব্লাড গ্রুপ ও অন্যান্য সম্ভাব্য কারণ খতিয়ে দেখে এমন রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছেন৷ তবে এখনো চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷
বিজ্ঞাপন
এটা অনেকটা জুয়া খেলার মতো৷ অনেক মানুষ, এমনকি তরুণ ও সক্রিয় হওয়া সত্ত্বেও করোনা ভাইরাসের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন৷ অন্যরা কিন্তু সুস্থ থাকেন৷
ইয়ুলিয়া এমনই একজন মানুষ৷ কিছুক্ষণ আগে তিনি প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে নিজের বাবার সঙ্গে প্রাতরাশ করছিলেন৷ সেই দিনই টেস্টে বাবার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে৷ দুই সপ্তাহ পরে ইয়ুলিয়ার বয়ফ্রেন্ডও ভাইরাস নিয়ে বাসায় ফেরেন৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তিন দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি৷ সে ‘সিটি ২১' মাত্রায় পজিটিভ ছিল৷ কিন্তু কয়েক দিন কেটে যাবার কারণে আমরা আর আলাদা হবার চেষ্টা করিনি৷ কিন্তু আমার সংক্রমণ ঘটেনি৷''
ইয়ুলিয়া সুস্থই থেকেছেন৷ কিছু কিছু মানুষ কেন চট করে সংক্রমিত হন না, গবেষকরা তা ব্যাখ্যা করতে নানা তত্ত্ব খাড়া করেছেন৷ ইমিউন সিস্টেম একটা কারণ হতে পারে৷ ভাইরাসের সংস্পর্শে আশার সময় গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে অথবা ব্লাড গ্রুপও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে৷
মলিকিউলার বায়োলজিস্ট হিসেবে আন্দ্রে ফ্রাংকে ও তাঁর টিম জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করছেন৷ কিছু মানুষ কেন অন্যদের তুলনায় সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পান, সেটা জানাই তাঁদের উদ্দেশ্য৷ সেই প্রক্রিয়ায় তাঁরা ব্লাড গ্রুপের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন৷ ব্লাড গ্রুপ ‘এ', ‘বি' না ‘ও', তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হচ্ছে৷ প্রো. ফ্রাংকে বলেন, ‘‘এবিও, ব্লাড গ্রুপের অবস্থা এবং সংক্রমণের সম্ভাবনার মধ্যে আমরা স্পষ্ট সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করছি৷''
রক্তের নির্দিষ্ট কোনো গ্রুপ কি রোগ এড়াতে সহায়তা করে?
মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন ব্লা়ড গ্রুপের লোহিত রক্ত কণিকায় আলাদা অ্যান্টিজেন থাকে৷ একমাত্র ‘ও' ব্লাড গ্রুপের একেবারেই কোনো অ্যান্টিজেন নেই৷ সে কারণে ‘ও' ব্লাড গ্রুপের মানুষ অন্য সব ব্লাড গ্রুপের মানুষকে রক্তদান করতে পারেন৷ তবে অন্য গ্রুপের মানুষের রক্ত গ্রহণ করতে পারেন না৷ অ্যান্টিজেন থাকার কারণে ইমিউন সিস্টেম সেই রক্ত প্রত্যাখ্যান করে৷
ফ্রান্সের এক গবেষক দলের তত্ত্ব অনুযায়ী ভিন্ন ব্লাড গ্রুপের মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই প্রবণতাই দেখা যায়৷ ‘ও' ব্লাড গ্রুপের কোনো মানুষ সহজে অন্য ব্লাড গ্রুপের মানুষের দ্বারা সংক্রমিত হন না৷ কিন্তু একবার সংক্রমিত হলে তিনি সহজেই বাকিদের সংক্রমিত করতে পারেন৷ প্রো. ফ্রাংকে বলেন, ‘‘শরীরের এক বা একাধিক কোষের মধ্যে ভাইরাস বংশবৃদ্ধির সময় প্রোটিন ও অন্যান্য পদার্থও উৎপাদন করে৷ ফলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷ বাস্তবে সেগুলি ব্লাড গ্রুপের অ্যান্টিজেন৷''
পরীক্ষায় দেখা গেল ইউলিয়ার ব্লাড গ্রুপ ‘এ'৷ তা সত্ত্বেও তিনি যে সুস্থ ছিলেন, তার কারণ হয়তো কম ভাইরাল লোড৷ সেই বিষয়টিও একটি ভূমিকা পালন করে৷
উলরিকে হাইমেস/এসবি
রক্তদানের আদ্যোপান্ত
রক্তদান কি কেবল অন্যের জীবন বাঁচায়? না, তা নয়৷ রক্তদাতাও এর মাধ্যমে উপকৃত হন বহুভাবে৷ তবুও চাহিদা অনুযায়ী মিলে না রক্ত৷ রক্তদানের আদ্যোপান্ত জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Fotolia
যাঁরা রক্ত দিতে পারেন
১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি কোনো মানুষের ওজন অন্তত ৪৫ কেজি হলেই তিনি রক্ত রক্ত দিতে পারেন৷ রক্ত দিতে পারেন তিন মাস পরপর৷ তবে রক্তদানের জন্য ব্যক্তিকে সুস্থ থাকতে হবে৷ দাতার রক্তের স্ক্রিনিং টেস্ট বা রক্ত নিরাপদ কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে৷ ভরপেট খাওয়ার চার ঘণ্টা পর রক্ত দেওয়া শ্রেয়৷ যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তদান করতে পারেন৷
ছবি: Fotolia
যাঁদের রক্ত দিতে মানা
ক্যানসার, হিমোফিলিয়া, ম্যালেরিয়াসহ জীবাণুঘটিত কোনো রোগ, এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত, মাদক সেবনকারী, হেপাটাইটিস-বি ও সি আক্রান্ত ব্যক্তি ও গর্ভবতী নারীরা রক্ত দিতে পারবেন না৷ যাঁদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট আছে এবং যাঁদের শরীরের কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড (লিম্ফনোড) ফুলে গেছে, তাঁদেরও রক্ত দেওয়া নিষেধ৷
ছবি: Universität Tübingen/Christoph Jäckle
রক্ত যাঁদের প্রয়োজন
দুর্ঘটনায় আহত, ক্যানসার বা অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য, অস্ত্রোপচার কিংবা সন্তান প্রসব অথবা থ্যালাসেমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় রক্তেরপ্রয়োজন হয়৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে আট থেকে নয় লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা রয়েছে৷ এর মধ্যে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ সংগ্রহ হওয়ায় ঘাটতি থাকে তিন লাখ ব্যাগের বেশি৷ এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে৷
ছবি: Fotolia
কে কাকে রক্ত দিতে পারেন?
সাধারণত নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের ব্যক্তি নির্দিষ্ট গ্রুপকে রক্ত দিয়ে থাকে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপেও রক্ত সঞ্চালন করা যায়৷ এক্ষেত্রে ‘ও-নেগেটিভ’ হলো সর্বজন দাতা এবং ‘এবি-পজেটিভ’ হলো সর্বজন গ্রহীতা৷
ছবি: Yohannes G/Egziabhare
কোন রক্ত লাগে বেশি
যদিও ৮টি গ্রুপের রক্তেরই প্রয়োজন পড়ে, তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাগে ‘ও পজিটিভ’ রক্ত৷ বিশ্বের ৩৫ শতাংশ মানুষের এই রক্ত রয়েছে৷ এর পরের অবস্থান ‘এ পজিটিভ’-এর – শতকরা ৩০ভাগ৷ সবচেয়ে বিরল রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
রক্তদানের পর...
রক্ত দেওয়ার পর একটু মাথা ঘোরানোটা স্বাভাবিক৷ কারণ, এ সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম আয়রনও কমে যায়৷ এ কারণে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা৷ এ সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া দরকার৷ আর রক্তদাতা যদি ঘামতে থাকেন এবং অস্থিরতা হয়, তবে তাঁকে স্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শও দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা৷
ছবি: DW/P. Samanta
রক্তদানের উপকারিতা
রক্তদানে যে কেবল মানুষের জীবন বাঁচে, তা নয়, এর মাধ্যমে রক্তদাতাও উপকৃত হন নানাভাবে৷ এর মধ্যে কয়েকটি হলো– নিয়মিত রক্তদান করলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়, অস্থি-মজ্জা সক্রিয় থাকে ও দ্রুত রক্ত স্বল্পতা পূরণ হয়৷
হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে
রক্ত দিলে রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে পিরিয়ড হওয়ার কারণে নারীর হৃদরোগ তুলনামূলকভাবে কম হয়৷ এ কারণে পুরুষদের প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস পর পর রক্তদানের পরামর্শ দেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রক্তদান করলে ফ্রি পরীক্ষা
বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা খরচে সম্পন্ন হয়ে যায়৷ এর মাধ্যমে জানা যায়, শরীরে অন্য বড় কোনো রোগ যেমন—হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) প্রভৃতি আছে কিনা৷